কালো টাকা সাদা করায় ফায়দা হচ্ছে কাদের?

গেল বছরেও বাজেটে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, ‘দেশের প্রচলিত আইনে যা–ই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।’

এ ছাড়া একই সময় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাগণ পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে, ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করলে, আয়করসহ কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না। দেশজুড়ে এমনিতেই দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ব্য তার উপর বাজেটে এই কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব যেন দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি আর কালো টাকা বৈধকরণের সীলমোহর।

যদিও বলা হয়েছে করোনা পরিস্থিতিতে রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে কিন্ত আসলে এটা নিজেদের অবৈধ টাকা বৈধকরণের এক ঘৃন্য প্রয়াস ছাড়া আর কিছুও নয়। এতে করে কালো টাকার মালিকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে আরও মরিয়া হয়ে উঠবে তারা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কালোটাকা সাদা করার দুটি উপায় রয়েছে।প্রথমত, ঢালাওভাবে বিনা প্রশ্নে সাদা করার সুযোগ। সে ক্ষেত্রে ৫-১০ শতাংশ কর দিয়ে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত টাকা ঘোষণায় আনলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।

আরেকটি উপায় হলো, বিদ্যমান কালোটাকা সাদা করার সুবিধা সম্প্রসারণ করা। বর্তমানে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে কালোটাকায় ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ আছে। রাজধানী, চট্টগ্রাম, জেলা শহর, পৌর এলাকাভেদে কালোটাকায় ফ্ল্যাট কিনে বর্গমিটারপ্রতি ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কর দিলে কোনো প্রশ্ন করছে না এনবিআর। এই অর্থবছরে করের পরিমাণ কমিয়ে জমি কেনায়ও কালোটাকা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

বিগত অর্থবছরে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ছিলো। সেখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকৃত অর্থের ১০ শতাংশ কর দিলেই প্রশ্ন করে নি এনবিআর। ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সুযোগ আছে। এই অর্থবছরের জন্য এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের নতুন খাত যুক্ত করা হতে পারে। যেমন কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, বড় অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি।

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে নন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই)। কেননা তারা স্বীকার করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে অতীতে কখনো খুব বেশি রাজস্ব পাওয়া যায়নি এবং আগামীতেও পাওয়া যাবেনা। অথচ এখানে শিল্পপতিদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার যুক্তি দেখিয়ে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। তারা দিব্যি ভুলে বসে আছেন অতীতে কতজন শিল্প–উদ্যোক্তা কালোটাকা দিয়ে শিল্প করেছেন।

এনবিআর সূত্রে আরও জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কেউ হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কালোটাকা বিনিয়োগ করেনি। গত এক বছরে কালোটাকায় ফ্ল্যাট কেনায়ও তেমন সাড়া নেই বললেই চলে। এই সংখ্যা একশর মতো।

কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, অনেকেই সেই সুযোগটি নিয়েছেন। গত ১ জুলাই অর্থবছর শুরু হওয়ার পর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ হাজার ৬৫০ ব্যক্তি ঘোষণা দিয়ে অপ্রদর্শিত আয়ের কালো টাকা সাদা করেছেন। এভাবে গত ছয় মাসে  প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি কালো টাকা সাদা হয়েছে। এনবিআরের তথ্য বলছে, গত ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত যেখানে মাত্র সাড়ে তিন হাজার ব্যক্তি কালো টাকা সাদা করেছিলেন,  সেখানে শুধু ডিসেম্বরেই সাদা হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এনবিআরে জমা দেওয়া রিটার্ন থেকে জানা যায়, নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, ফ্ল্যাট ও জমি কিনে কালো টাকা সাদা করেছেন ৭ হাজার ৪৪৫ জন। আর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করেছেন ২০৫ জন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস কি? কে করবে এই প্রশ্ন?

কালো টাকা সাদা করার এই আইন বাতিল, কালো টাকার মালিকদের গ্রেফতার এবং দুর্নীতি ও অর্থপাচার বন্ধ না হলে দেশটা রসাতলে যাওয়ার আর কিছুই বাকি থাকবে না। অবশ্য এই সরকার এই ধরনের পদক্ষেপ নিজেদের স্বার্থেই নিয়েছে। তা না হলে এই করোনাকালীন বিপর্যয়ের মধ্যেও গত ৬ মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি কালো টাকা সাদা হত না কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশেও পাচার হত না। রক্ষকই এখানে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ন।

 

You may also like...

Read previous post:
সাহেদের যত অপকর্ম

করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান, অর্থ আত্মসাতসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে...

Close