পোশাক শিল্পের দুর্নীতির জন্য দায়ী কারা?

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপিতে অবদান বৃদ্ধি এর সবকিছুতেই পোশাক শিল্পের ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার মাত্র ৭ বছর পরে প্রায় শুণ্য থেকে শুরু করে মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছা এবং দশ লাখের অধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা এ শিল্পের জন্য অনেকটা কল্পনাতীত ছিল। এই শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমিকের সিংহ ভাগ নারী শ্রমিক যার অধিকাংশ এসেছে গ্রাম এলাকার হত দরিদ্র পরিবার থেকে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বাংলাদেশ ছিল কৃষি নির্ভর প্রান্তিক অর্থনীতির দেশ। কেবলমাত্র পাটজাত দ্রব্য ও কাঁচামাল ছাড়া কোন রপ্তানি পণ্য ছিল না। তেমন অবস্থা থেকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা পোশাক শিল্প আজ বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। গত ৩৫ বছরের চরাই উৎরাই পার হয়ে আজ দেশের পোশাক খাতে আবির্ভূত হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ এবং অস্থিতিশীল বিশ্ব বাজার। এসব কিছুই দেশের অর্থনীতির জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প খাতকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। একই সাথে এ শিল্পের সম্ভবনাও কম নয়।
গত শতাব্দীর ৭০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত রপ্তানি খাতে পোশাক শিল্পের নাম ছিল না। ১৯৭৬ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস এবং জুয়েল গার্মেন্টস পোশাক শিল্পে যোগ দেয়। রিয়াজ গার্মেন্টস ষাটের দশকেই পোশাক শিল্প কারখানা গড়ে তোলে তবে তা ছিল স্থানীয় বাজার ভিত্তিক। সর্বপ্রথম ১৯৭৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস ফ্রান্সে পোশাক রপ্তাান শুরু করে। ১৯৭৮ সালে নুরুল কাদের, একজন সরকারী আমলা ও মুক্তিযোদ্ধা, কোরিয়ার দাইয়েয়ু কোম্পানির সহায়তায় পোশাক রপ্তানি শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে আরও কয়েকটি ফার্ম এগিয়ে আসে। তবে ১৯৮০-৮১ সালের আগ পর্যন্ত এই শিল্পের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
১৯৭৭-৭৮ সালে ২২টি ফার্ম পোশাক রপ্তানি করে ৪০ হাজার ডলার আয় করে এবং এর দু’বছর পর থেকেই রপ্তানি আয় ও ফার্মের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। ১৯৭৩-৭৪ সালে রপ্তানি আয়ে নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্যের। তবে ক্রমেই পোশাক শিল্পের বৃদ্ধি রপ্তানি আয় দখল করে নেয়।
তবে প্রচুর সম্ভাবনাময় এই তৈরি পোশাক শিল্পে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এই অনিয়ম, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে ‘ঘুষ’ লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায়। তারা পোশাক খাতের সরবরাহ চক্রের (সাপ্লাই চেইন) তিনটি পর্যায়ে অন্তত ১৬টি ধাপে দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে। তারা আরও জানিয়েছে, ‘সাপ্লাই চেইনের কার্যাদেশ, উৎপাদন ও সরবরাহ- এই তিনটি পর্যায়েই দুর্নীতি বিদ্যমান।’
যে ১৬টি ধাপে দুর্নীতির তথ্য পাওয়ার কথা টিআইবি বলছে, সেগুলো হলো- ব্র্যান্ড/আমদানিকারকের সঙ্গে স্থানীয় এজেন্ট/বায়িং হাউজের যোগাযোগ, কমপ্লায়েন্ট কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ, কার্যাদেশ প্রদান, মূল্য নির্ধারণ/ দর কষাকষি, স্যাম্পল করার নির্দেশ, মাস্টার এলসি-ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা, উৎপাদনের কাঁচামাল/দ্রব্য ক্রয়/আমদানি, পণ্যের মান ও কমপ্লায়েন্স পরিদর্শন, প্রাক জাহাজীকরণ পর্যায়ের মান পরিদর্শন ও জাহাজীকরণ (এফওবি/সিএ্যান্ডএফ)।
পোশাক শিল্পে পণ্যের মান, পরিমাণ ও কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি ধামাচাপা দেওয়া হয় ঘুষের মাধ্যমে। রয়েছে সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব আর তাছাড়া সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য চাঁদাবাজিও কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মোটকথা হল সাপ্লাই চেইনের পুরো প্রক্রিয়াই অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘেরাটোপে আবদ্ধ।
সাধারণত অনিয়ম দুর্নীতির জন্য সরকারি কর্মকর্তারা দায়ী করা হলেও বিভিন্ন প্রতিবেদনে আরও অনেক অনিয়মের কথাও সামনে এসেছে। এই অনিয়মের সঙ্গে কমবেশি সবাই জড়িত। তাই এককভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়ী করা ঠিক হবে না। বায়ার, এজেন্টসহ যারাই এ খাতে সংশ্লিষ্ট, তারা কেউ এই দায় এড়াতে পারে না।
পোশাক শিল্প ব্যবসায় যারা জড়িত তাদের নৈতিকতা ও ব্যবসায়িক আচরণবিধি সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। এছাড়া কারখানাগুলোর জন্য আলাদা সণাক্তকরণ নম্বর চালু, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পরিশোধে সরকারের তদারকি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং এক্ষেত্রে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের নীতি প্রয়োগে কঠোর হওয়া প্রয়োজন।

You may also like...

Read previous post:
সরকার কেন এখনই ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হচ্ছে না?

কিছুদিন আগেও, কোনো বিদেশি বাংলাদেশ নিয়ে কথা বললে, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সদস্যসহ আওয়ামী লীগের কাছ থেকে উত্তেজনাপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন...

Close