নানান ঘাত প্রতিঘাত পেড়িয়ে সেই ১৮৬২ সাল থেকে কখনো আসাম-বাংলা রেলওয়ে, কখনো পূর্ব বাংলা রেলওয়ে হয়ে ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়। সে হিসাবে ১৫৬ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস বাংলাদেশ রেলওয়ের। স্বাধীনতার পর রেলপথ যে পরিমাণ কমেছে, তার তুলনায় রেলপথের সম্প্রসারণ হয়েছে আরও কম। বিশেষত আশি ও নব্বইয়ের দশকে দাতাগোষ্ঠীর পরামর্শে অনেক স্থানীয় রেলপথ বন্ধ করে দেওয়াসহ রেলওয়ে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময়ে সড়ক যোগাযোগের ওপর বেশি জোর দেওয়ায় মনোযোগ হারায় রেলপথ। বিগত এক-দেড় দশকে রেলপথে বিনিয়োগ ও নানা উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলেও তা রেলসেবায় প্রাণ সঞ্চার করতে পারেনি।
অথচ নিরাপদ গণপরিবহন হিসেবে রেলপথে নাগরিকদের আগ্রহ সবসময় যেমন ছিল, তেমনি উত্তরোত্তর তা বেড়েছেও। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেলের যাত্রী পরিবহন প্রায় সোয়া এক কোটি বৃদ্ধি তারই প্রমাণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, যাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রেলের লোকসানও। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ কোটি ৭৮ লাখ যাত্রী পরিবহন করে রেলের লোকসান ছিল প্রায় ১২০০ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯ কোটির কাছাকাছি যাত্রী পরিবহন করে রেলের লোকসান বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকায়। বাংলাদেশ রেলওয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি এই চিত্র থেকেই বোঝা যায়।
রেলপথ বাচাতে এবং বাংলাদেশ রেলওয়েকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনায় ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়’ নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। কিন্তু আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন, রেল বাজেট বৃদ্ধি হলেও একের পর এক স্টেশন বন্ধ, মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, জরাজীর্ণ রেল কারখানা, লোকবল সংকট, সময়মতো গন্তব্যে পৌছতে না পারা, টিকিট পেতে ভোগান্তি, মানসম্মত আসন না থাকা, যাত্রীদের নিম্নমানের খাবার পরিবেশন আর সব মিলিয়ে অত্যন্ত নিম্নমানের যাত্রীসেবা এ অবস্থা থেকে এখনো বের হতে পারছে না রেলওয়ে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের এই করুণ দশা নিয়ে নাগরিকরা দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষুব্ধ। তবে এবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদনেও রেলে সীমাহীন দুর্নীতির চিত্র খানিকটা উঠে এসেছে। দুদকের প্রতিবেদনে জমি লিজ দেওয়াসহ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ইঞ্জিন ও বগি সংগ্রহসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ রেলওয়েতে ১০টি উৎসে দুর্নীতি চিহ্নিত করে রেলের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনাসহ ১৫ দফা সুপারিশ করেছে কমিশন। তবে বিগত দশকগুলোতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিচালন ব্যয়সহ নানা খাতে বাংলাদেশ রেলওয়েতে কোন কোন খাতে কী কী এবং মোট কত টাকার দুর্নীতি হয়েছে এমন কোনো ধারণা দুদকের প্রতিবেদনে পাওয়া যায়নি। ফলে বলা যেতে পারে দুদকের এই প্রতিবেদন অনেকটাই পরামর্শমূলক। এ অবস্থায় দুদক রেলওয়ের দুর্নীতি নিয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত পরিচালনা করে প্রতিবেদন দিতে পারে এবং সেই অনুযায়ী দোষীদের বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা যেতে পারে।
রেলওয়েতে বিগত সময়ে বিনিয়োগ বাড়লেও তা মোটেই সুপরিকল্পিত হয়নি। কেননা, রেলপথে যাত্রী বাড়ানো, আয় বাড়ানো এবং লাভজনক করা এসব প্রকল্পগুলোতে গুরুত্ব পায়নি। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা এবং সংশ্লিষ্টদের ব্যবসায়িক স্বার্থকেই হয়তো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এই চলমান সীমাহীন দুর্নীতি না থামিয়ে রেলপথের আধুনিকায়ন সম্পন্ন করতে পারবে না।
যারা রেলপথ ও সেতু সংস্কারের সরকারি বরাদ্দ লুটেপুটে খাচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি ট্রেন চলাচলে ঝুঁকি হ্রাসে সব ব্যবস্থা অবিলম্বে নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ অবকাঠামো উন্নয়নে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।