বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্প বড় হচ্ছে। দেশের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকেও জানতে হবে, কীভাবে খাদ্যশিল্পের সঙ্গে কাজ করতে হয়। যেটা বিএসটিআই করছে সেটা খাদ্যশিল্পের জন্য সঠিক পদ্ধতি নয়। দেশের মানকাঠামো পর্যালোচনা করে তাদেরকে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএসটিআই খাদ্যের মান পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোডেক্স (আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মান ও পরীক্ষার রীতি) অনুসরণ করছে না। উন্নত দেশে খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করার যে রীতি রয়েছে, সেটা আমাদের দেশে আনা জরুরি।
ভেজাল পন্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। আমরা প্রতিনিয়ত যেসব খাবার গ্রহণ করি তার মধ্যে রয়েছে ভেজাল। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রক্রিয়াও এখন ব্যতিক্রমধর্মী। ভোক্তা সাধারণের চোখে ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ভেজাল মেশানো যায় সেদিকে বেশি নজর রাখছেন এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা। জমি থেকে ফসল তোলা থেকে শুরু করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণের জন্য প্রস্তুত ফ্যাক্টরীগুলোতেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। ভেজালেরও বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। যে খাদ্যে যে ধরণের ভেজাল মেশালে সহজে চোখে ধরা পড়ার কোনো সুযোগ নেই সেদিকেই নজর রাখছে চক্রান্তকারীরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চোখে ফাঁকি দিয়েই চলছে এসব কাজ।
সব খাবারে ভেজাল কী খাবে মানুষ? নিরাপদ কোনো খাবার আদৌ কিনা তা জানা নেই। মাছে ও দুধে ফরমালিন, ফলমূলে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল, সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে মবিল, বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিংক্স, জুস, সেমাই, আচার, নুডুলস এবং মিষ্টিতে টেক্সটাইল ও লেদার রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজ, পানিতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, লেড, ইকোলাই। কৃত্রিম রং মিশিয়ে নকল ঘি বানানো হচ্ছে। এমনকি শিশুদের বিকল্প খাদ্যেও মেলামিন (ভেজাল) মেশানো হচ্ছে। আম, আনারস ও টমেটোতে কেমিক্যাল মিশিয়ে হলুদ করা হচ্ছে। এমনিভাবে দেশের প্রতিটি খাবারেই ভেজাল মেশানো হচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী খাবার স্যালাইন নকল তৈরি হচ্ছে। শুঁটকি আড়তে প্রকাশ্যেই কীটনাশক মেশানো হচ্ছে। গরুকে নিষিদ্ধ ঔষধ খাইয়ে মোটা করা হচ্ছে।
ভেজাল খাদ্য এক নীরব ঘাতক। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানব দেহের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। মানুষের লিভার, কিডনি নষ্ট করে ফেলে। মানুষ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মানহীন এসব ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রকম ক্রনিক রোগে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আর কত দিন এসব চলবে? আর কতদিন আমরা ভেজাল খাব?
ভেজাল খাবার খেয়ে আমরা জাতিকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি, নতুন প্রজন্মকে মেধাহীন পঙ্গু জীবনের মতো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। কোথায় নেই ভেজাল? হাত বাড়িয়ে যা কিছু খাচ্ছি সবকিছুতেই ভেজাল। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ভেজাল ও নকল পণ্য। সেই পণ্য চলে আসছে বাজারে। আসল পণ্যের হুবহু নকল সিল-মনোগ্রাম, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না নিয়ে নকল অনুমোদনপত্র ছাপা হয়ে যাচ্ছে প্যাকেটের গায়ে। নকলের দাপটে এখন আসল পণ্য চেনাই দায় হয়ে পড়েছে। বাজার সয়লাব হয়ে গেছে এসব নকল পণ্যে।
ভোজাল খাদ্য থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য সরকারী উদ্যোগ থাকলেও তা কাঙ্খিত নয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ। ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার থেকে নিরাপদ থাকতে ভেজালবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। আমাদের বাজার থেকে ভেজাল পণ্য একেবারে তুলে দিতে হবে। বিএসটিআইকে এ ব্যাপারে নিতে হবে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা। বাজারে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান জোরদার করতে হবে। ভেজালকারীদের সামান্য জেল-জরিমানায় কাজ হবে না। যারা জনস্বাস্থ্যকে ঠেলে দিতে পারে হুমকির দিকে, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নকল বা ভেজাল ওষুধ ও খাদ্যপণ্যের কারখানা একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রি করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৪ বছর কারাদন্ডের বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। ভেজালবিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ হলে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ যেমন আশা করা যাবে তেমনি ভেজালের হোতারাও নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য হবে। খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধে সরকার,ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম কর্মীসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সরকারকে এই ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।