একটি দেশের বিচার ব্যবস্থা কতটা স্বাধীন তার উপর নির্ভর করে সে দেশের জনগনের অধিকার রক্ষার বিষয়টি। বিচার বিভাগ সভ্যতার সোপান। সংবিধানই একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। আর ন্যায়বিচার একটি ধারণা। এটি বাস্তবায়িত করতে গেলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আদালত বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সংবিধানের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতাকে নানাভাবে পরিবর্তিত করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টসের (ডব্লিউজেপি) জরিপে দেখা গেছে, বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশ তালিকার নিচের দিকে অর্থাৎ অবনতির দিকে যাচ্ছে। তবে এ সত্যটি ক্ষমতাসীন দল স্বীকার করতে নারাজ। ডব্লিউজেপির অনুসন্ধানে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩টি দেশের মধ্যে ১০২তম। সংস্থাটির জরিপে চলতি বছরে নতুন আরো ১৩টি দেশ যুক্ত হয়ে মোট ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম স্থানে এসেছে। সূচকের শীর্ষে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ফিন্যান্ড। সূচকের নিচে আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভেনিজুয়েলা। ডব্লিউজেপি সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা এই বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে সূচক তৈরি করেছে। কিন্তু এই অপরিহার্য উপাদানগুলোর প্রতি বাংলাদেশের কোনো সরকারই মনোযোগ দেননি।
মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। অথচ সরকারের আইনমন্ত্রী ডব্লিউজেপির জরিপকে পক্ষপাতমূলক হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বাংলাদেশের বিচারকদের স্বাধীনতা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এবং মূল সংবিধানের মাধ্যমেই বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে না কি দিন দিন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে, বিচারপতি নিয়োগে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কি (সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৫ মোতাবেক) নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সাথে সুপারিশ করতে পারছেন, না কি সরকারের সিদ্ধান্তই প্রধান বিচারপতির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নের দাবি সরকার কর্তৃক উপেক্ষিত হয়েছে বারবার।
শুধু ষোড়শ সংশোধনীর রায়ই নয়, দফায় দফায় গণমাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের টানাপড়েন চোখে পড়ে। বিচার বিভাগ আলাদা হলেও নিম্ন আদালতের বিচারকদের এখনও নিয়ন্ত্রণ করে আইন মন্ত্রণালয়৷ তাদের বদলি, পোস্টিং এখনো আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে রয়ে গেছে৷ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিদায়ও কম নাটকিয়তার মধ্যে হয়নি। তবে তিনি কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে থাকবেন। প্রধান বিচারপতিই যেখানে ছাড় পান না এক ধরনের অনিশ্চয়তা, সরকারের অনভিপ্রেত দখলদারি মনোভাব এবং আইনকে প্রভাবিত করার এক ধরনের অপচেষ্টা এসব নিয়েই বিচার বিভাগকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
প্রভাব বিহীন বিচার ব্যবস্থা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠির সদিচ্ছার উপরে। কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ যতই স্বাধীন হোক না কেন, সেখানে রাষ্ট্রের নির্বাহীকে কোনো না কোনো কারণে অযাচিত খুশি রাখা যেন একটি অলিখিত কনভেনশন হয়ে দাড়িয়েছে।