সরকার কি সমালোচনার উর্ধে?

ক্ষমতার (শাসক, অভিভাবক, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রভৃতির) সমালোচনা করার অধিকার হল বাকস্বাধীনতার সবচেয়ে দামি অংশ। এই মত প্রকাশের অধিকারই হচ্ছে গণতন্ত্রের সুস্থতার মাপকাঠি। গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল শাসকের সমালোচনা করার স্বাধীনতা। কিন্ত সরকার সর্বদা এই ধরনের মত প্রকাশ করা কে দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া হয়েছে বলে ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। তবে কেউ যদি সোশাল মিডিয়ায় খুন-ধর্ষণের হুমকি দিয়ে থাকে তা অবশ্যই বাক-স্বাধীনতার আওতায় পরবে না।
সরকারের অংশ সকল রাজনৈতিক নেতাদের এটা বোঝা উচিৎ সব সমালোচনা নিরীহ হয় না, ভালো লাগার মতো হতে পারে না। সমালোচনার উত্তরে হিংস্র না হয়ে সুস্থ গণতান্ত্রিক জবাব নেতাকে শাসক হবার উপযুক্ত করে তোলে। সমালোচনার প্রতি সহনশীল হবার একমাত্র উপায় এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস দৃঢ় করা, যে সমালোচনা করার অধিকারটি মানুষের মৌলিক অধিকার। সমালোচনার জবাব দেওয়া যায়, কিন্তু অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়া যায় না।
গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী সরকার সমালোচনার মোকাবিলা করতে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন কেন করবে? যদি তা করেই ফেলে তবে প্রথম সুযোগেই কি তা শুধরে নেবে নাকি সেই পদ্ধতিই আঁকড়ে থাকবে এবং নিজেদের সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টায় আরও বেশি অগণতান্ত্রিক কাজ করবে এসবই সরকারের সহনশীলতার উপর নির্ভর করে।
ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মানসিকতার তফাত থাকবেই কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে সরকার হচ্ছে নির্বাচিত কতিপয়ের সমন্বয়। অনেকের মধ্যে থেকে মাত্র কয়েকজন প্রতিনিধি সেখানে থাকে এবং কোন ধরনের মানুষজন সেই প্রতিনিধি হবে তা জনগণ নির্বাচিত করে। নির্বাচিত সরকারে সাধারণ ভোটারদের মনোভাবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে এটুকু প্রত্যাশিত যে নির্বাচিত সরকার সকলের সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে সম্মান দেবে। সমালোচনার উত্তর তারা দিতে পারে, জোরালো প্রতিবাদ করতে পারেন, পাল্টা সমালোচনাও করতে পারে কিন্তু সমালোচকদের কথা বলার সুযোগটুকু অন্তত দেয়া প্রয়োজন। ভয় দেখিয়ে, আটক করে অথবা বাধ্য করে সকলকে চাটুকার বানানোর অপচেষ্টা করলে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ হবে না সরকারের। যদি এই সামান্য নীতিটুকুও কোনো সরকার বিসর্জন দেয় তবে দেশটি আর গণতান্ত্রিক থাকে না। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ সেই গণতন্ত্রহীনতার দিকে এগোচ্ছে।
সরকার বিরুদ্ধ বাচনের প্রতি চরম অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে যা গণতান্ত্রিক সরকারের চেয়ে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার সঙ্গেই বেশি মানানসই।  সরকারের সমালোচনা করা যাবে না বলে নির্দেশ। মুখ খুললেই অহেতুক হয়রানির শিকার হতে হয়। সরকারের কাজের সমালোচনা করা, কোনো মন্ত্রী বা প্রভাবশালী ব্যক্তি কার্যকলাপের প্রতি বক্তৃতা, ব্যঙ্গচিত্র বা হাস্যকৌতুকে কটাক্ষ করার মতো কারণে সাধারণ নাগরিকদের গ্রেফতার হবার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে গত কয়েক বছর ধরে। যে দেশে খুন, ধর্ষণের আসামি সহজে গ্রেফতার হয় না, সে দেশে এহেন গ্রেফতারের ঘটনা ক্রমাগত ঘটতে থাকা নিশ্চিতভাবে এই বার্তা দেয় যে ভালো কাজ করে প্রশংসা আদায় করা নয়, কাজের যাবতীয় সমালোচনার সম্ভাবনাকে গলা টিপে মারাই শাসকদের লক্ষ্য। প্রশাসন কী অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে বা কীভাবে কেস সাজিয়েছে, তার সবটা জানা বা সত্যতা যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
শুধু গণমাধ্যম নয় দেখা যায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজেদের বিরুদ্ধে হওয়া সমালোচনার জবাবে মূল সমস্যাটাই অস্বীকার করে সরকার। সরকারের বক্তব্য শুরুই হয় যেকোন অভিযোগ অস্বীকার করার ভিত্তিতে। সরকার বলে ক্রসফায়ার হয় না, গুম হয় না, দুর্নীতি হয় না, পক্ষপাতিত্ব হয় না এবং তারা এও বলে যে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারে কোন বাধাবিপত্তি নেই। যদিও বাস্তবচিত্র ভিন্ন কথা বলে।
সবসময় সরাসরি বাধা দেয়া না হলেও পরোক্ষভাবে বাধা প্রয়োগ করা হয় গণমাধ্যমের ওপর।সংবাদমাধ্যমগুলি এই চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে যদি নিজেদের নীতিতে স্থিত হয়ে কাজ চালিয়ে যেতে পারে তবে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে অন্যথায় সরকারের সমালোচকদের প্রতি এই কঠোর নীতি দেশের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না।

You may also like...

Read previous post:
শিশুদের যৌন হয়রানী

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণের ঘটনার খবর প্রায়ই পড়ছি। তবে তা সংঘটিত অপরাধের মাত্র ২৫-৩০ ভাগ প্রকাশ হচ্ছে। বেশিরভাগ প্রকাশ হয়...

Close