১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও পরে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের আড়ালে অন্তত সতেরোটি ক্যু চেষ্টা, অতঃপর তার হত্যাকাণ্ড এবং তার অল্পকাল পরেই জেনারেল এরশাদের প্রলম্বিত সামরিক শাসনে বাংলাদেশে কমবেশি উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে৷ জিয়া পর্বে সামরিক আদালতে উল্লেখযোগ্য সেনা সদস্যের ফাসি হওয়ারও একটি বিরাট প্রতিক্রিয়া সমাজে পড়েছে৷ সর্বত্রই একটি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন কিংবা প্রভাব বিস্তারের মনোভাব লক্ষনীয়।
আবার ২০০৮ সালের সঙ্গে ২০১৮ সালের বাংলাদেশের যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে তা হচ্ছে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন। দশ বছর আগে বাংলাদেশে যখন নির্বাচন হয়েছিল, তখন তার আগের দুবছর দেশটির ক্ষমতায় ছিল একটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ক্ষনিকের জন্য একটা আশাবাদ তৈরি হয়েছিল মাত্র। এক রিপোর্টে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে নতুন পাঁচ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের কাতারে ফেলেছে। একটি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং বিরোধী দলকে দুর্বল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র কিন্ত চলছেই।
প্রভাব খাটিয়ে সরকার পরিবর্তন ছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্যনীয়৷ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি, বেসরকারি মোটামুটি সবক্ষেত্রেই কমবেশি রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে দেখা যায় অনেককেই। সরকারি খাতে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব বা অবৈধ অর্থ প্রদানের সামর্থ বা ঘুষ আদান-প্রদান চাকুরীতে নিয়োগ প্রাপ্তির ভরসাযোগ্য উপায়। এখানে মেধা বা যোগ্যতা আর তেমন কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। এরকম শুধু চাকুরির ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও চলে রাজনীতির পালাবদলের খেলা। প্রতিপক্ষকে, যেকোন মূল্যে বিতাড়িত করাই মূল লক্ষ্য অথবা একেবারে নিশ্চিহ্ন করা গেলে তো আর কথাই নেই।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অসংখ্য নজির অতীতেও যেমন দেখা গেছে তেমনি এখনো দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক মদদে অবৈধভাবে জমি দখল করে কোন নিয়ম না মেনে অধিক মুনাফার আশায় ভবন নির্মান করা হয়। সেইসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তার অনুমোদন দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ ক্ষমতাবানদের সাথে যোগসাজসের মাধ্যমে অবৈধভাবে দখলকৃত জমিতে অবৈধ প্রক্রিয়ায় আইন ও বিধিমালা অমান্য করে নির্মিত ভবনে অবৈধভাবে পরিচালিত পোষাক কারখানায় ঝুঁকি চিহ্নিত হওয়া স্বত্ত্বেও কাজে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করে তড়িৎ মুনাফার লোভে শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। অজানা কারণে এইসব ঘটনা সামনে আসলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই তার বিচার বিশ্লেষণের আগেই প্রতিপক্ষের প্রতি আঙুল তোলা হয়। এটাই যেন সহজে দায় এড়ানোর উপায়।
অবৈধ জমি দখল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, গনমাধ্যম সহ ব্যবসা বানিজ্যে লাইসেন্স-পারমিট ও সরকারী ক্রয় খাতে রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রাধ্যান্য প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। রাজনীতির সাথে ব্যবসার যোগসূত্র উদ্বেগজনক ভাবে বৃদ্ধির কারনে ক্ষমতার অপব্যবহার অপ্রতিরোধ্য রয়ে গেছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের মূল পেশা ব্যবসা তাদের অনুপাত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ১৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দশম সংসদে ৫৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর এসব সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রার্থী রাজনীতিবিদরা টাকার পাহাড় গড়ে তার মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। জনসেবা কিংবা জনস্বার্থে কাজ করার কোন বালাই নেই।
বাংলাদেশের এই বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তারের ঘটনা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের রাজনীতিতে অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং পুরনো প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সকলে একসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করার। অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় টিকে থাকার অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে বেড়িয়ে আসার এখনই সময়।