রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি বন্ধ ঘোষণা করে সরকার বাকিগুলোও বন্ধের আয়োজন করেছে। ছয়টি চিনিকল সরকার ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করেছে। কিন্তু আগামী মৌসুমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সবগুলো চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্ত আয়োজনই সরকার করে চলেছে।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে পরবর্তী বছরের আখ চাষের জন্য চিনিকল থেকে বীজ, সার, কীটনাশক ও ঋণ দেওয়া হয়। এ বছর কোনো চিনিকল থেকেই আখ চাষিদের সেই ঋণ ও প্রণোদনা সরবরাহ করা হয়নি। ফলশ্রুতিতে কৃষকদের মধ্যে আশঙ্কা বিরাজ করছে এ বছর আখ চাষে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটবে। আখের অপর্যাপ্ততার কারণে চিনিকলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে।
দেশের ১৫টি চিনিকলের মালিকানায় ১৯ হাজার ৯৬ একক জমি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে নয় হাজার ১৬ জন কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে ৭১৪ জন কর্মকর্তা, চার হাজার ৪০১ জন কর্মচারী ও তিন হাজার ৯০১ জন শ্রমিক রয়েছেন। চিনিকল শ্রমিক ও আখচাষিদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, “এক কেজি আখের উৎপাদন ব্যয় ৬ দশমিক ৬১ টাকা, আর কৃষক সেটা চিনিকলের কাছে বিক্রি করে ৩ দশমিক ৫০ টাকা। সরকার যে চিনিকলের লোকসানের কথা বলে তা কী আদৌ সত্য? আর লোকসান হলেও সেই দায় কার?”
১৯৩৩ সালে দিনারপুরের সেতাবগঞ্জ ও গোপালপুর চিনিকল দুটি ব্রিটিশ আমলে একই মালিক স্থাপন করেছিলেন। তখন একজন ব্যবস্থাপকই কারখানা চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। এখন প্রতিটি কারখানায় একজন এমডি, চারজন জিএম, ডজনখানেক ডিজিএমসহ বিশাল মাথাভারী প্রশাসন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে চিনিকলগুলোতে। মাসে শ্রমিকদের মজুরি যা দেওয়া হয় তার তিন/চারগুণ বেশি বেতন দেওয়া হয় কর্মকর্তা কর্মচারীদের।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর সংকটের বড় কারণ হলো চিনির উৎপাদন খরচ আমদানি করা চিনির বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। এই উৎপাদন ব্যয়ের একটা বড় অংশ আবার ঋণের সুদ।
বিক্রয় মূল্য থেকে উৎপাদন ব্যয় বেশি হলে লোকসান হবে এটা অর্থনীতির সাধারণ সূত্র। উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার কারণগুলো হচ্ছে- আখের অপর্যাপ্ত সরবরাহ, অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় একর প্রতি আখের ফলন অনেক কম, পুরাতন প্রযুক্তি ও মেশিনের কারণে আখ থেকে চিনি আহরণ হার (রিকভারী রেট) অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় প্রায় অর্ধেক, পণ্যের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে উদ্যোগহীনতা, চিনি বিপণনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক হতে না পারা, আখ কেনা থেকে শুরু করে চিনি উৎপাদন ও বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতায় বেড়ে ওঠা পাহাড়সম ব্যাংকঋণ ও তার সুদ, অপ্রয়োজনীয় জনবলের বেতনভাতা প্রভৃতি।
চিনি শিল্প রক্ষায় রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল বন্ধ না করে ভুলনীতি ও দুর্নীতি দূর করে আধুনিকায়ন করে কারখানা চালু করতে হবে। লোকসানের জন্য দায়ি নীতি-নির্ধারক, দুর্নীতিবাজ আমলাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া মজুরি, কৃষকদের আখের বকেয়া মূল্য পরিশোধ, উন্নতজাতর আখ উদ্ভাবনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা বাড়ানো এবং আখ চাষিদের ন্যায্যমূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক সময় মত পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা প্রয়োজন। অথচ যা করনীয় তা না করে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান একের পর এক বন্ধ করেই যাচ্ছে।
করোনাকালে গত বছরের জুলাই মাসে আওয়ামী সরকার পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক ও লাখ লাখ পাটচাষির জীবনজীবিকার কথা বিবেচনায় না নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পঁচিশটি পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। করোনাকালেই আখচাষি ও চিনিকল শ্রমিকদের অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়ে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পনেরটি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দিয়েছে। চিনিকল, পাটকলসহ সব রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রচার ও প্রসারে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।