ভাস্কর্য নিয়ে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক ছলচাতুরী 

ভাস্কর্য নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বহু তর্ক বিতর্ক হতে হতে এখন তা রাজনীতিকে স্পর্শ করেছে। এর পিছনেও রয়েছে ঘৃন্য রাজনীতি। নিতান্ত  ইচ্ছাকৃতভাবে এটাকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে যেই মতবিরোধ দেখা দিয়েছে সেটি মোটেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বরং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের সাথে জড়িত।

সরকার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করতে চায়। সরকারের এ সিদ্ধান্তে দ্বিমত প্রকাশ করেন আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখগণ। তারা বলছেন ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলামসম্মত নয়। আর এই মতামতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন সরকারি দলের কিছু নেতা ও দলীয় সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। তারা বলছে ইসলামে মূর্তির ব্যাপারে বিধিনিষেধ থাকলেও ভাস্কর্যের ব্যাপারে নেই। ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়। ভাস্কর্য আসলে মূর্তি নয় শিল্পকর্ম।

দেশবরেণ্য কিছু আলেমরা বলেন, ভাস্কর্য বা মূর্তি যাই বলা হোক না কেন, যে কোনো উদ্দেশ্যেই তা তৈরি করা হোক না কেন, ইসলামে তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমন কি কোনো মহৎ ব্যক্তি বা নেতার ভাস্কর্য বা মূর্তি স্থাপন করে শ্রদ্ধা জানানোও শরীয়তসম্মত নয়। এরপর থেকে আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।  তাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী, নব্য রাজাকার, তালিবান ইত্যাদি অভিধায় চিহ্নিত করা হচ্ছে।

যারা এই বিরোধিতাকে মৌলবাদের প্রকাশ, ধর্ম নিরপেক্ষতার খেলাপ ইত্যাদি বলছে তারা হয়ত ভুলে গেছে যে, বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের প্রার্থনালয়ে তাদের পূজ্য দেবদেবীর মূর্তি আছে এবং তারা নিয়মিতই সেখানে তাদের পূজা-অর্চনা করে থাকেন। সে ব্যাপারে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখের কোনো বক্তব্য নেই। যার যার ধর্ম তার তার। এ ব্যাপারে কোনোরূপ বাড়াবাড়ি করার অধিকার কোনো মুসলমানকে দেয়নি ইসলাম। আমাদের সংবিধানেও প্রত্যেকের স্বাধীন ও স্বধর্ম পালনের অধিকার দেয়া হয়েছে। কাজেই, ভাস্কর্যের ব্যাপারে বিরোধিতা বা ভিন্নমত প্রকাশের কারণে ধর্মনিপেক্ষতার হানি ঘটল, সম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটল কিংবা মৌলবাদের উত্থান ঘটল বলে উদ্বেগ প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই।

পূজার জন্যই হোক, শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যই হোক কিংবা হোক সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য, ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ ইসলাম সমর্থন করে না। মূর্তিকে যারা ভাস্কর্য বলে বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখাতে চাইছেন, হয় তাদের জানা-শোনার ঘাটতি আছে, না হয় জানা-শোনা সত্ত্বেও তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই কাজটি করছেন।

ভাস্কর্য বা মূর্তি শিরক বা পৌত্তলিকতার দিকে টেনে নিয়ে যায় বলে তা নির্মাণ বা স্থাপন নিষিদ্ধ। যারা বলেন, মুসলিম দেশগুলোতে তো বহু ভাস্কর্য রয়েছে; সে সব ভাস্কর্য রাষ্ট্রনায়ক ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের। কামাল আতাতুর্ক, জামাল আবদুন নাসের, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ক এবং আল্লামা ইকবাল, রুমি, ফেরদৌসী, শেখ সাদী প্রমুখের ভাস্কর্য বিদ্যমান রয়েছে। যদি ভাস্কর্য নিষিদ্ধই হয়, তবে সে সব দেশে ভাস্কর্য থাকে কী করে? তাদের এ বক্তব্যের জবাবে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, কোনো মুসলিম দেশে ভাস্কর্য আছে বলেই এটা ভাবা সঙ্গত নয় যে, ইসলাম তা অনুমোদন করে।

একটি ভারতীয় পত্রিকায় সম্প্রতি বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নাকি ইসলামী চরমপন্থার পুনরুত্থান দেখা দিয়েছে। এতে ভারত অতিশয় উদ্বিগ্ন। ভারতের এ উদ্বেগ বাংলাদেশে সঞ্চারিত করা ইসলাম বিরোধী একটা ঢেউ সৃষ্টি করার মত, খবরটির এমন উদ্দেশ্য থাকা বিচিত্র নয়। এর মধ্যেই কিছু আলামত লক্ষ করা গেছে বৈকি! ইসলামী চরমপন্থার ‘সাক্ষ্য’ হিসাবে ভাস্কর্য ভাঙার তিনটি ঘটনা ইতোমধ্যেই ঘটেছে। কারা এসব করছে, সেটা নিশ্চিত হওয়ার আগেই আঙুল তোলা হচ্ছে তথাকথিত ইসলামী চরমপন্থীদের দিকেই।

ভাস্কর্য যে মূর্তি না এটা নিয়ে বেশ মায়াকান্না হচ্ছে। কিন্তু ভাস্কর্য সম্পর্কে ইসলাম কি বলে? মূর্তি, ভাস্কর্য যেটাই বলা হোক কোন প্রাণীর অবয়বের আদলে বানানো যে কোন Sculpture কিংবা statue নিঃসন্দেহে হারাম, এবং এই কাজ নিঃসন্দেহে কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। এটা কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে এতটা বেশি স্পষ্ট যে এটা নিয়ে  মুসলিম দাবীদার কোন মানুষ বিন্দুমাত্র দ্বিমত হবার সুযোগ পর্যন্ত নাই।

কোন একটা কাজ করার আগে অবশ্যই চিন্তা করা উচিত যে কাজটার বেনেফিট কি। এটা যে কোন বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই বিবেচনা করে। ভাস্কর্য নির্মাণের কোন Feasible Benefit কি কেউ দেখাতে পারবে? আদৌ কি এর বিন্দুমাত্র বেনেফিট আছে? কিন্ত তারপরও এটা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথার শেষ নেই।

শুধু মূর্তি অপসারন এই আলোচনার কারন নয়, ইদানীং এক বিরাট ভণ্ড স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি সম্প্রদায় চারা দিয়ে উঠেছে। তারা এই বর্তমান মূর্তিভিত্তিক রাজনীতিটা খুব কাজে লাগাতে ব্যস্ত। বর্তমান সরকারের এক বিরাট কর্মীদল বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা নিবেদনের নামে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করতে ব্যস্ত। নাম ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার ব্যবসানীতি ও রাজনীতি চলছে ধুমসে। স্বাধীনতার নাম ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার রাজনীতির কারনে ইতিমধ্যেই নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমী হওয়া তো দূরের কথা, এই দেশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝে উঠার ব্যাপারে একেবারে অনিচ্ছুক ও উদাসীন হয়ে পড়েছে।

 

You may also like...

Read previous post:
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, যাকে এসকে সিনহা নামে সবাই চেনেন; তিনি ছিলেন একজন সৎ লোক। চোরের রাজত্বে সৎ...

Close