চলছে ধর্ষণের মহাযজ্ঞ, নিরব সরকার।

বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে রাষ্ট্রে খুন-গুম ধর্ষণ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় ধর্ষকরা অপরাধ করেও নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং নির্যাতিতদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। আজকে জাতি প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।

দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে৷ বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিংবা ছয় বছরের শিশুও৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে এসব নারী ও শিশুকে৷ অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে আর নতুন করে আর কোন ধর্ষনের ঘটনা ঘটত না।

গত সাত সেপ্টেম্বর রাতে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের সাঁতারপুর গ্রামে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক দরিদ্র রিকশাচালকের ছয় বছরের শিশুকন্যা৷ বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ঘরের সিঁদ কেটে তাকে  নিয়ে যাওয়া হয়৷ একই গ্রামের আলী হোসেন ধর্ষণের পর শিশুটিকে বাড়ির পাশে একটি ধানেক্ষেতে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে৷ সকালে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়৷ এরপর ৫৫ বছর বয়সি আলী হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ৷ পুলিশ জানিয়েছে, আলী হোসেনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের একাধিক অভিযোগ রয়েছে৷

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ১৩ বছরের এক শিশুকে জোর করে তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে মো. মাসুদসহ তিন যুবকের বিরুদ্ধে৷

সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ এই ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ এদিকে এই ধর্ষণের ঘটনার পর এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ‘ছাত্রলীগের দখলে’ থাকা হিসেবে পরিচিত একটি কক্ষে অভিযান চালিয়ে পুলিশ একটি পাইপগান, চারটি রামদা ও দুটি লোহার পাইপ উদ্ধার করে৷ কক্ষটি ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাইফুর রহমানের৷ পরে তার নামে অস্ত্র আইনেও আরেকটি মামলা হয়েছে৷ জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজের সামনে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন৷ এখন প্রশ্ন হল, এই করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ থাকার পরও ছাত্রাবাস কীভাবে খোলা রাখে কলেজ কর্তৃপক্ষ? এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ অবগত থাকার পরও কেন ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেয়া হলো না? এই দায় কলেজ কর্তৃপক্ষ কিভাবে এড়াবে?

খাগড়াছড়িতে এক আদিবাসী পরিবারের বাড়ির দরজা ভেঙে গৃহকর্তা, তার স্ত্রী ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ের হাত-মুখ বেঁধে ফেলে দুর্বৃত্তরা৷ পরে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে পাশের রুমে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করে৷ এসময় বাড়ির আলমারি থেকে তিন ভরি স্বর্ণ, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন লুট করে নিয়ে যায় তারা৷ পরদিন সকালে গৃহকর্ত্রীর চিৎকারে স্থানীয়রা এসে তাদের উদ্ধার করে৷ এ ঘটনায় ধর্ষণের শিকার নারীর মা বাদী হয়ে অজ্ঞাত নয়জনকে আসামি করে মামলা করেন৷ এর প্রতিবাদে জেলা সদরে মানবন্ধন করেছেন সাধারণ মানুষও৷ এছাড়াও সম্প্রতি দেশের বিভিন্নস্থানে এমন আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে৷ ছয় বছর ও ১৩ বছরের শিশুকেও ধর্ষণ করেছে দুর্বৃত্তরা৷

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক তরুণীকে (২০) দুইদিন ধরে আটকে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে৷ ফরিদপুর থেকে গোবিন্দগঞ্জে আসেন ওই তরুণী৷ এ সময় কয়েকজন যুবক তাকে গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের একটি বাড়িতে আটকে রেখে ধর্ষণ করে৷ সেখানে দুইদিন আটকে থাকার পর কৌশলে পালিয়ে ওই তরুণী সরাসরি গোবিন্দগঞ্জ থানায় উপস্থিত হন৷

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১৪) ধর্ষণ করেছে তার ‘প্রাইভেট শিক্ষক’ মাজহারুল ইসলাম রায়হান৷  ছাত্রীর বাবা-মা বাসার বাইরে থাকার সুযোগে প্রাইভেট পড়াতে এসে ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন তিনি৷ বাবা-মা বাড়িতে ফিরলে ওই ছাত্রী বিষয়টি তাদের জানায়৷

পটুয়াখালীর দুমকীতে মেহেরুন্নেছা গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নেছার উদ্দিন কর্তৃক অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছে।

দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। ৩১ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো এক তালিকা থেকে এই তথ্য জানা গেছে। পুরো বছরে দেশে ১৩৪৬ কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ৩৪৪০ জন নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। যেখানে ২০১৯ সালে দেশে একহাজার ৩৭০টি ধর্ষণ, ২৩৭টি গণধর্ষণসহ চার হাজার ৬২২টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিলো।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২০২০ সালের মোট ৩৪৪০ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১০৭৪ জন ধর্ষণ, ২৩৬ জন গণধর্ষণ ও ৩৩ জন ধর্ষণের পর হত্যা ও ৩ জন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যাসহ মোট ১৩৪৬ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

এইসব ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা৷ এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না৷ আবার অনেক সময় পুলিশ এইসব ক্ষমতাশালীদের গ্রেফতারও করে না৷ যারা রাজনৈতিকভাবে বা আর্থিকভাবে ক্ষমতাশালী তারা পুলিশেরও ধরাছোয়ার বাইরে। কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে৷ ফলে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমাজে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না৷ এই কারণে এদের থামানোও যাচ্ছে না৷ এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে অপরাধ কমানো যাবে না। একমাত্র সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জাতি ধর্ষণের কবল থেকে রক্ষা পেতে পারে।

 

You may also like...

Read previous post:
অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবি

চলতি বছরের (২০২০) আরও একটি দুখঃজনক ঘটনা অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবি। যাত্রীরা দেখতে পাচ্ছিলেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা গন্তব্যে পৌছাবেন...

Close