জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে সবগুলো নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতি’ করে ক্ষমতাসীনরা আসন দখল করেছে। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পৌরসভার প্রত্যেকটি নির্বাচনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই জালিম সরকার হয় দখল করে নিয়েছে নয়তো ডাকাতি করে নিয়েছে। শুধু রাতের আধারে ব্যালট ছিনতাই নয় বাদ যায়নি ইভিএম মেশিনও। সেখানেও তারা কৃতিত্বের সংগে কারসাজি-কারচুপি করেছে। অর্থাৎ সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকেই তারা আজ কার্যত অথর্ব করে দিয়েছে। শুধুমাত্র অবৈধভাবে নিজেরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
এটা আমাদের দুভার্গ্য আজ স্বাধীনতার এতো বছর পরেও আমরা দেখছি যে, বস্তুত আমাদের কোনো স্বাধীনতা নাই। আজকে আমাদের ন্যূনতম যে অধিকার, সংবিধান সম্মত যে অধিকার সেই অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আমাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এদেশের মানুষকে তার কথা বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এদেশের মানুষকে ভিন্ন মত পোষণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের একটি শ্রেণিকে বিপুল বিত্তের অধিকারী করা হচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ তারা দারিদ্র্যের আরও অতল গহ্বরে চলে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে, মানবাধিকার লুণ্ঠন করা হয়েছে। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের ভোট প্রদানের অধিকার আজ যেন রুপকথার গল্পে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে আজ একটি গভীর অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকট শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়, অর্থনৈতিক সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। সেই সংকট মানুষের ন্যূনতম বাস করার যে পরিবেশ তার সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং স্বাধীনতার সংকট শুরু হয়েছে। আমাদের যে ন্যায্য অধিকারগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে সেগুলো আমরা পাচ্ছি না। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন বলা যেতে পারে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ নয়। এই দেশ আজ ভোট চোর, ভোট ডাকাতের। গাইতে গাইতে যেমন গায়েন এই লূটেরা সরকার তেমন চুরি করতে করতে এতটাই সাহসী হয়ে গিয়েছে যে আজ তারা ডাকাতি করতেও বিন্দুমাত্র ভাবছে না।
গত এক দশকে জাতীয় কিংবা স্থানীয় সব নির্বাচনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিরোধীদের কোণঠাসা করতে পেরেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। চলতি পৌরসভা নির্বাচনেও তারা এই ধারা অব্যাহত রেখেছে। তবে এতেও স্বস্তি মিলছে না আওয়ামী লীগের। কারণ, সহিংসতা, ভোটকেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার এবং নির্বাচন–পরবর্তী উত্তেজনা এগুলো এখন তাদের বা হাতের খেলায় পরিণত হয়েছে।
এখন কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয় কোনো বড় খবর নয়। জয়টা কীভাবে এল, সেটাই একটা খবর। নির্বাচনে জিততে দলের মনোনীত প্রার্থীরা নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীকেও নিশানা বানাতে ছাড়ছেনা। আর তাইতো নির্বাচন সুষ্ঠু হলে দলীয় প্রার্থী ‘পালানোর পথ খুঁজে পাবে না’, এমন বক্তব্যও আসছে তাদের নিজ দলের প্রার্থীর কাছ থেকেই। মানে তারা বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে করতে এখন নিজেরা নিজেরা কাদা ছোরাছুরি করছে।
মনোনয়ন থেকে শুরু করে জয়—সবটাই এখন প্রার্থীর টাকা ও প্রভাবের ওপর চলে। দল ক্ষমতায় আছে বলে টাকাওয়ালা ও প্রভাবশালীর সংখ্যাও বেড়েছে। ফলে সংঘাত, কেন্দ্র দখল ও প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার বিষয়গুলো সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে।
নতুন করে খবরের শিরোনাম হয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভায় সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে গত ৩ জানুয়ারি তিনি ও তার কর্মীরা সড়ক অবরোধ করেন। হঠাত করেই বিবেকবোধ জাগ্রত হওয়ায় পরিবার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নিয়ে তিনি কড়া সমালোচনা করেন। আর তখনপর তাকে বলতে শোনা যায়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, কিন্তু ভোটের অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি।’ দলের স্থানীয় সাংসদদের ইঙ্গিত করে তাকে বলতে শোনা গেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটা আসন ছাড়া বাকি আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদেরা পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না। এসব বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ এখন মানুষের মুঠোফোনে ঘুরছে।
দেশের জনগণই শুধু নয় এখনতো খোদ আওয়ামী লীগের নেতারাও কথা বলতে শুরু করেছে যে, দেশে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা পালানোর পথ খুঁজে পাবেনা। এই সরকার ও নির্বাচন কমিশন মিলে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাটাকেই ভেঙে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ ধারণা তৈরি হয়েছে যে শক্তি থাকলে যেকোনো কিছুই করা সম্ভব। তাই তারা ভোটডাকাতির মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনব্যবস্থাকে দিন দিন আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।