সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, যাকে এসকে সিনহা নামে সবাই চেনেন; তিনি ছিলেন একজন সৎ লোক। চোরের রাজত্বে সৎ লোকের স্থান হয় না, এর প্রমাণ হচ্ছে সিনহা সাহেবের সাথে আওয়ামীলীগ সরকারের আচরণ।
সিনহাকে বিচারপতি করার প্রশ্নে হাছান মাহমুদ বলেছিলেন-
“১৯৯৯ সালে দুটি বিবেচনায় আপনাকে হাই কোর্টের বিচারপতি করা হয়েছিল। প্রথমত আপনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দ্বিতীয়ত আপনি উপজাতীয় সম্প্রদায়ের…আমার মতে, মৌলভীবাজার কোর্টের একজন আইনজীবী… শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী না হত, কোনোদিন হাই কোর্টের বিচারপতি হতে পারতেন না।”
পাঠক, ভাবতে পারেন? হাছান মাহমুদ স্বীকার করে নিয়েছেন দেশে যোগ্যতার চেয়ে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষকে উন্নতি দেয় আওয়ামীলীগ!
এসকে সিনহার বিরুদ্ধে এতো বিষোদগার কেন? কী কারণে উনার সাথে এত বাজে আচরণ? কেন ডিজিএফআই লেলিয়ে দিয়ে তাকে দেশ ছাড়া করানো?
সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ এনেছে দুদক। এই অভিযোগ এসেছে আওয়ামীলীগের সাথে তার দুরত্ব হবার পরে!
২০১৭ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত একটি মামলার আপিলের রায়কে কেন্দ্র করে। এ রায় নিয়ে সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে একই বছরের ১৩ অক্টোবর তিনি রীতিমতো বোমা ফাটিয়ে বিদেশে চলে যান। দেশত্যাগের সময় সাংবাদিকদের দেওয়া বিবৃতিতে সিনহা বলেছিলেন যে, তিনি অসুস্থ নন। তবে সরকারের তরফ থেকে তখন বলা হয়েছিল, বিচারপতি সিনহা অসুস্থ। তাই তিনি চিকিৎসার জন্য ছুটি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। সিনহার ছুটির মেয়াদ শেষ হলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারপতি সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। পদত্যাগ করার পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
সেই সময়ের কথা তুলে ধরে বিচারপতি সিনহা তার বইয়ে লিখেছেন, ‘পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী, তার দলের লোকজন এবং সরকারের মন্ত্রীরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আইনমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনতে থাকেন।’ ওই সময় তাকে বাসভবনে আটকে রাখা হয় এবং আইনজীবী ও বিচারপতিদের তার সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেওয়া হয় বলেও বইয়ে অভিযোগ করেন এস কে সিনহা। এস কে সিনহা বলেন, ‘আমাকে যখন কমপ্লিটলি হাউস অ্যারেস্ট করা হলো, তখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন একজন করে ডাক্তার আমার কাছে পাঠানো হতো। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না।’ ‘এর মধ্যে একটি সংস্থার প্রধান এলে বললেন, হ্যাঁ, আপনাকে বলা হলো আপনি বিদেশ যাবেন, আপনি যাচ্ছেন না।’
‘আমি বললাম : কেন যাব আমি বিদেশে ?’
‘আপনি চলে যান, আপনার টাকা পয়সার আমরা ব্যবস্থা করছি।’
‘আমি বললাম, এটা হয় না, আমি আপনাদের টাকা নেব না। আর আপনারা বললেই আমি ইয়ে করব না। আমি চাই সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি আলাপ করি। ব্যাপারটা কি হয়েছে আমি জানতে চাই। তিনি বলেন যে প্রধানমন্ত্রী আপনার সঙ্গে কথা বলবেন না।’
সিনহার কী এমন অপরাধ ছিল যার কারণে প্রধানমন্ত্রী, যিনি কি না পদাধিকারবলে সিনহার অধীনস্থ, তিনি তার সাথে কথা বলবেন না?
মহামান্য বিচারপতি এসকে সিনহা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী যা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দিয়েছিল তাকে অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়েত উপর আপীলকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। তার মতে বিচারকদের বিচার বিচারবিভাগই করবে। এছাড়াও তিনি আরো কিছু মন্তব্য করেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
‘এই সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মুখে বিচার বিভাগই তুলনামূলকভাবে স্বাধীন অঙ্গ হিসেবে কাজ করছে, ডুবতে ডুবতে নাক উঁচিয়ে বেঁচে থাকার মতো। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগও খুব বেশী দিন টিকে থাকবে না। এখনো পর্যন্ত উচ্চ আদালতের বিচারকদের নির্বাচন ও নিয়োগের কোন আইন হয়নি। নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা সংকুচিত করতে আগ্রহী। আর যদি তা হয় তাহ’লে এর চেয়ে ধ্বংসাত্মক আর কিছু হবে না’।
‘এমন একটি পঙ্গু সমাজে আমরা আছি, যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না। কিন্তু খারাপ লোকেরা আরও লুটপাটের জন্য বেপরোয়া’। কোন একজন ব্যক্তি দ্বারা কোন একটি দেশ ও জাতি তৈরী হয়নি। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা চাইলে আমিত্বের আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার মতো কোন নযরদারী প্রতিষ্ঠান (ওয়াচডগ) নেই। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষারও ব্যবস্থা নেই। নির্বাহী দাম্ভিক ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় আমলাতন্ত্র কখনোই দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হবে না’।
‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিরোধের স্পৃহার মাধ্যমে আমরা সামরিক শাসনের থাবা থেকে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু পরাজিত হয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্রে। এমনকি স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও আমরা আমাদের একটি জনপ্রতিষ্ঠানকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। আর এ কারণেই সুবিধাভোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহারে উৎসাহিত হন এবং যত্রতত্র ক্ষমতার অপব্যবহারের ধৃষ্টতা দেখান। রাষ্ট্রক্ষমতার যা রাজনৈতিক ক্ষমতার আরেক রূপ, সাম্প্রতিক সময়ে তা গুটিকয়েক মানুষের একচ্ছত্র বিষয়ে পরিণত করেছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণের আত্মঘাতী প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতার লিপ্সা মহামারির মতো, যা একবার ধরলে তা দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন, কোন ক্ষমতাধর দৈত্যের জন্য নয়’।
নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে এবং কোনরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হ’তে পারলে গণতন্ত্র বিকশিত হ’তে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গ্রহণযোগ্য সংসদ প্রতিষ্ঠা হয় না।
“… মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা। আর প্রযুক্তির উন্নতির সহায়তা নিয়ে অপরাধের প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম নয়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাহী বিভাগ আরও অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর আমলাতন্ত্র দক্ষতা অর্জনে চেষ্টাহীন।”
এই সকল মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। এবং সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তারা ধীরে ধীরে এসকে সিনহাকে পদত্যাগ, দেশত্যাগ এবং শেষ পর্যন্ত পলাতক আসামী বানিয়ে দিয়েছে।