আওয়ামীলীগের আদর্শ (১৯৭৫-বর্তমান)

আগের দুই পর্বে আওয়ামীলীগের আদর্শিক ইতিহাসের কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নিয়ে লিখেছিলাম। আওয়ামীলীগের সময়কালকে তিন ভাগে ভাগ করে আলাদা করে আলোচনা করা সহজ হয়। প্রাক-স্বাধীনতা, মুজিবীয় আমল, এবং মুজিব পরবর্তী আমল।

আমার বলতে কোনো দ্বিধা নাই যে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ট্রাজিক ঘটনা। সপরিবারে মুজিব হত্যা বাংলাদেশের কপালে সবচেয়ে বড় পাপ। পরিস্থিতি যেমনই থাক না কেন মুজিবের পরিবারকে হত্যা করা কোনোভাবেই ন্যায্যতা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।

মুজিবের অপশাসন, আওয়ামীলীগের আদর্শিক মেরু পরিবর্তন, রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন, স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ সব মিলিয়েই ১৫ই আগস্টের পটভূমি তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকার অবকাশ নাই। একইভাবে শিশু রাসেলকে হত্যা করার কোনো নৈতিক কারণ নাই, এও দ্বিমতের উর্ধ্বে।

যাই হোক, ১৫ই আগস্ট এবং জেল হত্যার পর আওয়ামীলীগ মোটামুটিভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল। এখানে আওয়ামীলীগের আরেকটা প্রবণতা দেখা যায়। আওয়ামীলীগ কখনো সেকেন্ড ইন কমান্ড বানায় না। মুজিবের অনুপস্থিতিতে যে দেশ স্বাধীন করলো, সে তাজউদ্দীনই আওয়ামীলীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। কারণ তার জনপ্রিয়তা। আওয়ামীলীগ তোষামোদকারী বানায়, নেতা বানায় না। তাদের নেতা একজনই থাকে। তার কোনো বিকল্প নাই।

সে যাই হোক, ১৯৭৫ এর পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। মোটামুটি একটা আন্ডারগ্রাউন্ড দলে পরিণত হয়েছিল আওয়ামীলীগ। ৭৫ এর আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামীলীগ বলতে কিছুই ছিল না দেশে। খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থানের পর আওয়ামীলীগ কিছুটা স্বস্তি পেয়ে রাস্তায় নেমেছিল, সেটাও দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।

জিয়ার আমলে আওয়ামীলীগ আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিল বেগম তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে। মুজিবের সমাজতন্ত্রী আওয়ামীলীগ আবারো ধণিক শ্রেণির আওয়ামীলীগে রূপ নেয়। জিয়ার বেঁধে দেয়া শর্ত মতে তারা মুজিবকে আড়াল করেই রাজনীতি করছিল। তবে কিছু লোক অন্তরে শেখ মুজিবকে আর তার পরিবারকে ধারণ করছিল।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে। এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। একাধিক সেনা বিপ্লব আর আভ্যন্তরীণ সমস্যায় স্বাধীনতার ঘোষক, প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছিল। সেনা, বিমানের বিপথগামী সদস্যরা তাকে উৎখাত করার নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিল, আর জিয়া কঠোর হাতে সেসব দমন করছিলেন। বামেরাও জিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। তবে জনগণ জিয়াকে ভালবাসতো। এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসা ব্যাপক আলোড়নের জন্ম দেয়। শেখ হাসিনা তার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া ট্রাজেডি পূঁজি করে দীর্ঘ দৌড়ের ঘোড়া হতে যাচ্ছিলেন, এই ব্যাপারটা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

হাসিনা দেশে ফেরার কিছু দিনের মধ্যেই জিয়া নিহত হলেন। ব্যাপারটা কেমন জানি সন্দেহজনক! এতে হাসিনার সম্পৃক্ততা আছে? নাকি হাসিনাকে দেখে সেনার বিপথগামীরা সাহস পেয়েছিল? জেনারেল এরশাদ কি হাসিনার সাথে আঁতাত করেছিল? বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি এখনো! নিতান্ত কাকতালীয় হতেই পারে না পুরো ঘটনা!

জিয়া নিহত হওয়ার পর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসলে আওয়ামীলীগ চুপ করে তাকেই রাষ্ট্রপতি মেনে নেয়। এর কারণ কী? জিয়াও সামরিক শাসক, এরশাদও সামরিক শাসক। একজনের বিরোধিতা করে আরেকজনের পক্ষে দাঁড়ানোর দ্বিচারিতাটা কেন?

এরশাদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যখন বেগম জিয়া আন্দোলন শুরু করলেন তখন হাসিনা হাওয়ার ঝোঁক বুঝে নৌকার পাল তুলে দিলেন। গণআন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে আওয়ামীলীগ ধীরে ধীরে অংশ নিতে শুরু করলো। তবে এরশাদের পতনের পর প্রথম নির্বাচনে দেশবাসী বেগম জিয়াকেই বেছে নিয়েছিল। হাসিনা তখন বুঝতে পেরেছিল, কূটরাজনীতি ছাড়া আওয়ামীলীগের কোনো সম্ভাবনাই নাই।

বেগম জিয়ার সরকারের আমলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালত প্রতিষ্ঠিত হয়ে ৭১ এর ঘাতক দালালদের প্রতিকি বিচার শুরু হয়। মতিউর রহমান রেন্টু লিখেন হাসিনা কীভাবে জাহানারা ইমামকে সহ্য করতে পারত না, কিন্তু জনগণের সমর্থনের লোভে তার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে যেন আওয়ামীলীগ শেষ ঘোমটাটাও সরিয়ে নিল! নির্লজ্জভাবে জামায়াতে ইসলামের সাথে দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনার জন্য আন্দোলন করলো! স্বাধীনতার পক্ষের একমাত্র শক্তি স্বাধীনতা বিরোধীদের সমর্থনে ক্ষমতায় এলো! তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফিরলো।

২০০১ সালে আবার তাদের ভরাডুবি হল। কারণ? অপশাসন,  দূর্নীতি, ছাত্রলীগের নিপীড়ন।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আওয়ামীলীগ বলেছিল তাদের আন্দোলনের ফসল। এইটা সেই সরকার যার আমলে বাংলাদেশ দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এই সরকারের আমলে সেনাবাহিনীর হাতে বিএনপির কর্মীরা নিহত হয়েছিল। আর এদের বদৌলতে আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় চলে আসলো। এবার তারা বুঝতে পারলো সোজা পথে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব না।

তারা এবার শুরু করল প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার কাজ। যে জামায়াতের সাথে মিলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনেছিল সে জামায়াতের নেতাদের ধরে ধরে ফাঁসি দেয়া শুরু করলো। বিএনপিকে মামলা-হামলা, গুম-খুন করে দূর্বল করে ফেললো। বিচারবিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণ করে তারা ক্ষমতা স্থায়ী করলো। সেক্যুলার আওয়ামীলীগ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে তোষামোদ করা শুরু করলো।

১৯৭৫ পরবর্তী আওয়ামীলীগ বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার তাই করেছে। এদের কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ নাই। কখনো ছিল বলে প্রতীয়মানও হয় না। এমন দল আসলেই অনেক বিপদজনক।

You may also like...

Read previous post:
ঢাকায় ক্লাব, হাউজি, ক্যাসিনো

ঢাকার স্পোর্টস ক্লাবগুলো থেকে খেলাধুলা বিদায় নিয়ে নিষিদ্ধ ব্যবসা কবে থেকে চালু হলো তা নিয়ে নানা ধরণের মত পাওয়া যায়।...

Close