বাংলাদেশে গেল বছরের (২০১৯) আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো ফেনী জেলার সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে এ ঘটনা নিয়ে সমালোচনা ওঠে। ২০১৯ সালের ৬ই এপ্রিল নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাদে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে ১০ এপ্রিল ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত।
গেল বছরের ২৭ মার্চ ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল অধ্যক্ষের সহযোগীরা পরীক্ষা কেন্দ্রের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে না নেয়ায় তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় বলে মৃত্যুশয্যায় জবানবন্দী দিয়ে গেছে নুসরাত। টানা ৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।
আলোচিত এই হত্যা মামলাকে ঘিরে আদালত প্রাঙ্গণে ছিল নিরাপত্তার কড়াকড়ি। নুসরাত হত্যার মামলটি প্রথমে সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন তদন্ত করলেও পরে ওই থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় গাফিলতির অভিযোগ ওঠায় এর তদন্তভার নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
১০ই জুন অভিযোগপত্র আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল, মামলায় গ্রেফতার ২১জন আসামীর মধ্যে পাঁচজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়।। তার পরের মাসে ২০শে জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৬জন আসামির বিচারকাজ। আসামীদের মধ্যে ১২জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। ৯ই সেপ্টেম্বর ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেয়া শেষ হয়। এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ঠিক করে আদালত।
নুসরাত হত্যার ঘটনায় দ্রুত বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন হয়েছিল। দেশব্যাপী আলোচিত এ মামলায় গত ২৪ অক্টোবর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল নুসরাত হত্যা মামলায় সব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করে সেই টাকা আদায় করে নুসরাতের পরিবারকে দেয়ার আদেশও দিয়েছে আদালত।
বহুল আলোচিত এই মামলার সাত মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, ৬১ কার্যদিবস শুনানির পর এ রায় ঘোষণা করা হয়। জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণাকে ঘিরে সোনাগাজী ও ফেনী সদর উপজেলায় কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
নুসরাত হত্যাকান্ডের ঘটনাটি শুরুতে গণমাধ্যমে আত্মহত্যা হিসেবে আসে। তবে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের দেয়া জবানবন্দীর পর এটি হত্যাকান্ড হিসেবে সামনে আসে। এছাড়া প্রথমে মামলা তদন্তকারী ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ভিডিও ফাঁস বিষয়ক মামলাটি বর্তমানে ডিজিটাল সাইবার ক্রাইম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ড এতো বেশি আলোচিত হওয়ার পেছনে কাজ করেছে এ ঘটনার নৃশংসতার মাত্রা। এছাড়া কোন ঘটনাকে যখন মিডিয়া সেনসেশনে পরিণত করে তখন সেটার পেছনে ওই সময়ের এক ধরণের সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টিও কাজ করে। প্রাথমিকভাবে আলেমদের অপমান আর প্রেমের ব্যর্থতাকে এই হত্যাকাণ্ডের কারণ মনে করা হলেও পরে জানা যায় ওই মাদ্রাসার সকলের স্বার্থে ঘাঁ দেওয়ার ফলেই ঘটেছিল এই নৃশংস হত্যাকান্ডটি।