ঘর থেকে বের হওয়ার পর একজন মানুষ আবার বাসায় ফিরতে পারবে কিনা এই নিয়ে আজকাল মোটামুটি কমবেশি প্রত্যেকেই আতংকিত। সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে বহুবার প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি দুর্ঘটনা নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট দুর্ঘটনার এই কারণগুলো চিহ্নিত করেছে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। এছাড়াও চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণ এবং ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ চালকদের বেপরোয়া মনোভাব ও অতিরিক্ত গতির কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ এসব নিয়ে কারো কোন জবাবদিহিতা নেই। এগুলো যাদের আমলে নেয়ার কথা তারা সেভাবে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলে আমাদের জীবন প্রতি মুহূর্তে হুমকির সম্মুখীন হতো না।
বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আমাদের সসড়কব্যবস্থা বিশৃঙ্খলতায় ভরপুর এবং দুর্ঘটনা প্রবণ। রাজধানী ঢাকার বাস সার্ভিসগুলোর দিকে তাকালেই যা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮-র জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায অন্তত ২৫ হাজার মানুষ নিহত হয় এবং আহত হয় প্রায় ৬২ হাজার মানুষ। এই সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রোববার দুপুর ১২টায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের দু’টি বাস প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়। বাস চাপায় সেখানেই প্রাণ হারান কলেজের দু’শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া খানম মিম। দু’জনের মৃত্যুর খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে নিরাপদ সড়ক পরিবহন আইনের দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। ওই বছরের ৮ অক্টোবর আইনটির গেজেট প্রকাশিত হয়।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পূর্বে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিল। গাড়িচালকদের বেপরোয়া গতি, অনভিপ্রেত আচরণ কেড়ে নিয়েছিল বেশকিছু তাজা প্রাণ। আন্দোলনের পূর্ববর্তী কয়েক মাসে দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব, বাসের হেলপার কর্তৃক নদীতে ফেলে দেয়া পায়েল, বাসচাপায় আহত সৈয়দ মাসুদ রানা ও সর্বশেষ বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থী প্রমুখের মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে সমালোচনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর থেকেই আন্দোলনের দানা বিধতে শুরু করে শিক্ষার্থীদের মনেও। তারা সহপাঠীদের অকাল মৃত্যুতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে, বিচার চায়।
বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। সরকার সব স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটসহ দেশের ৪২টি জেলায় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। ‘‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’’, ‘‘আমার ভাই কবরে, খুনী কেন বাহিরে’’ প্রভৃতি স্লোগানে ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা সড়ক মুখরিত করে রাখে।
শুধু বিক্ষোভ নয় এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা শহরের ট্রাফিকও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে গাড়ি আটকে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে। লাইসেন্সহীন চালক ও চলার অনুপযোগী গাড়িসমূহ ধরে ট্রাফিক পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ও তাদের মামলা নিতে বাধ্য করে।
শিক্ষার্থীরা শুধু আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি তারা লাইসেন্স না থাকায় ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে বাণিজ্যমন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারক, পুলিশের ডিআইজি প্রমুখ সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়িও আটকে দেয়। পথচারীদের ট্রাফিক নিয়ম মানানো এবং স্থান বিশেষে রাস্তা পরিষ্কার ও সংস্কারও করতে দেখা যায় তাদের। সড়কে গাড়িগুলোকে তারা লেন অনুসারে চালনা করে এবং তৈরি করে অ্যাম্বুলেন্স ও অগ্নিনির্বাপক গাড়ির জন্য ইমার্জেন্সি লেন যা ছিল বাংলাদেশে এই প্রথম। সাধারণ মানুষ তাদের কার্যক্রমের প্রশংসা করে এবং ট্রাফিক নিয়েন্ত্রণে পুলিশ তাদের সহায়তা করে; অনেকস্থানে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফুল ও চকলেট বিনিময় করতেও দেখা যায়। আসলে শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে সড়ক নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।