প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা চললেও এই কাজে নারীদের ব্যবহার অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। যদিও অপরাধ জগতে পুরুষের নিরাপত্তা ও সুবিধার স্বার্থে নারীকে ব্যবহার করার ইতিহাস একেবারে নতুন নয়। সম্প্রতি নরসিংদীতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান অপারেশন ‘গার্ডিয়ান নট’ এ পুরুষ জঙ্গিদের পাশাপাশি দুই নারী জঙ্গির আত্মসমর্পনের খবর প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে যতটুকু জানা গেছে, তারা নব্য জেএমবি’র সদস্য। একজনের নাম খাদেজা আখতার মেঘলা ওরফে খাদেজা, অন্যজনের নাম ইশরাত জাহান মৌ। আগেও তারা গ্রেপ্তার হয়েছিল। জামিনে কারামুক্তির পর আবার সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সাথে আবার যুক্ত হয়েছেন।
খবরটি নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর এবং একইসাথে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ ধরণের ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও বাংলাদেশে নারী সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গিদের গ্রেপ্তার কিংবা সক্রিয় কার্যক্রমের খবর পাওয়া গেছে। এই যেমন কিছুদিন আগেই নওরোজ রায়েদ আমিন নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক অষ্ট্রেলিয়ার নাগরিকের গ্রেপ্তারের খবর বেরিয়েছিল ঐ ঘটনাটি বিশেষ করে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের জন্যে অশনি সংকেত ছিল! এই সংবাদগুলো ছাপার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে তা হলো আগেই র্যাব কিংবা পুলিশের কাছে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে অন্তরীণ অথবা জামিনে আছেন। খালি চোখে হয়তো আলাদাভাবে গ্রেপ্তারের এই ঘটনাগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ নারীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাকে এখনো আমাদের সমাজে হালকাভাবে দেখার প্রবণতা আছে। অনেকেই তাই নারীর অপরাধকে সহমর্মিতা ও করুণার চোখে দেখেন। হয়তো এই কারণেই অপরাধবিজ্ঞানী অটো পোলাক নারীর অপরাধকে ‘গোপনীয় অপরাধ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আমার কাছে প্রশ্ন হলো, এই খাদিজা আখতার মেঘলা, ইশরাত জাহান মৌ কিংবা সাদিয়া আমিন নামে নারী জঙ্গি গ্রেপ্তারের খবর কি ব্যতিক্রম ঘটনা? আসলে তা নয়।
নির্বাচনপূর্ব এই জঙ্গি গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলোর বাস্তবতার সাথে সরকারের রাজনৈতিক কোন চাল কিংবা কূটচাল আছে কিনা সেই বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন। যেমন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামক সরকারি কর্মসূচিকে অনেকেই সে সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রনোদিত বলে চিহ্নিত করেছিলেন।
বাংলাদেশের সাধারণ জঙ্গি গ্রেপ্তার কিংবা বিশেষভাবে নারী জঙ্গি গ্রেপ্তারের সাথে অনেকেই রাজনৈতিক অর্থনীতির যোগসূত্র খোঁজেন। কেউ কেউ এসব ঘটনার সাথে রাষ্ট্রতন্ত্র, সিভিল ব্যুরোক্রেসি, মিলিটারী ব্যুরোক্রেসি তথা ডিপ স্টেটের আন্তঃসম্পর্কীয় ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকেই ভোটের পূর্বে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং দূর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কর্মসূচিগুলোকে একবিন্দুতে নির্দেশ করে ‘প্রক্সি ওয়ার’ প্রত্যয়টিকে সামনে আনতে চান। নাটকের পিছনে অনেক নট-নটী ক্রিয়াশীল তা তুলে ধরেন। রাজনীতির পিছনে কূটনীতি, অপরাজনীতি ও কূটচালগুলো কি তা তুলে ধরতে চান। প্রত্যেকটি বিশ্লেষণের মধ্যে খানিকটা আলাদা ও বিশেষ সত্যতা আছে বলেই আমি মনে করি। কারণ সত্য এক ও অভিন্ন নয়। এবং অনেকক্ষেত্রেই তা আপেক্ষিক কিংবা আংশিক সত্য।
সামাজিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানীরা যেমন প্রত্যেকটা ঘটনার কার্যকারণ ও প্রক্রিয়াকে আলাদাভাবে উদঘাটন করেন তেমনি অপরাধবিজ্ঞানের ছাত্র ও পাঠদানের সাথে যুক্ত থাকার কারনে নারী জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে আমার আলোচনা অপরাধবিজ্ঞানের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ।
যা হোক, বাস্তবে বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে এখনো পর্যন্ত প্রায় দেড় সহস্রাধিক নারী জঙ্গিকে পুলিশ চিহ্নিত করেছে বলে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় এসেছে। সারাদেশে সংঘটিত মোট সাধারণ (সহিংস ও সম্পত্তিসংক্রান্ত) অপরাধের মধ্যে দেড় হাজার সংখ্যাটি হয়তো খুব বেশি হবে না কিন্তু সন্ত্রাসবাদী অপরাধের ধরণ ও প্রভাব বিবেচনা করলে এই সংখ্যাটি মোটেও কম নয়। যদিও অপরাধবিজ্ঞাণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাস্তবে মাত্র প্রতি ১০ অপরাধের মধ্যে মাত্র একটি অপরাধ পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়। আর যেগুলো পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়না তাকে আমরা ‘ডার্ক ফিগার’ বা অপ্রদর্শিত সংখ্যা বলে বিবেচনা করি। তার মানে বাস্তব কারণেই এই সংখ্যা আরো অনেক বেশী হবে বলেই মনে হয়। অপরাধবিজ্ঞান শিক্ষকতায় যুক্ত থাকার কারণে এত সংখ্যক নারী কেন জঙ্গিবাদে যুক্ত হচ্ছে এই বিষয়টি উদঘাটন করা একটি জরুরি প্রশ্ন বলেই আমি মনে করি। তাই এই প্রবন্ধে নারীর ধর্মীয় জঙ্গিবাদের রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট, কার্যকারণ, প্রক্রিয়া ও সমাধানের উপায় নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
বাস্তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও আন্দোলনের কর্মসূচি এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ইতিহাস আছে। নারীর সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকার বিষয়ে একাডেমিক গবেষণাগুলোও তাই বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত।
প্রথমত ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে যেসব গবেষণা হয়েছে সেখানে রাশিয়ার বিপ্লব, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে গেরিলা রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোকে ফোকাস করা হয়েছে বেশি।
অন্যদিকে, ১৯৯০ এর দশকে ল্যাটিন আমেরিকার গেরিলা রাজনীতির মতো আয়ারল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী নারীরা সন্ত্রাসবাদে কেন যুক্ত হয়েছিলো তা ফোকাস করা হয়েছিল। কিন্তু তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিত দৃষ্টিকোণ থেকে ২০০০ সালে ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী সময়ে জ্ঞানকান্ডের বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান ও অপরাধবিজ্ঞানে নারী মনস্তত্ব, আত্নঘাতী বোমাহামলা, প্রেষণা, নারীর পরিচয়ের রাজনীতি, র্যাডিক্যালাইজেশন, ধর্ম, জাতীয়তা ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, নারীবাদ ও নারীবাদী তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারী সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে ব্যাপক লেখালেখি ও গবেষণা হয়।
প্রথমত এসব লেখালেখি ও গবেষণা হতে সন্ত্রাসবাদের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের মাত্রা সম্পর্কে জানা যায়। সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ সিন্ডি কে. ন্যাস ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক মতামত দেন। তাঁর মতে, গত দুই দশকে নারীদের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাত্রা এমন নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায় যে, কিছু কিছু ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলে মোট সদস্যর শতকরা ৩০ ভাগের বেশী হচ্ছে নারী।
একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও ২০০০ সালের ৯/১১ পরবর্তী বিশ্বপ্রেক্ষাপটের কারণে কিভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনে সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে যায় তা তিনি তুলে ধরেন। মেজর মারনি এল সুতেনের গবেষণায়ও একইমত পাওয়া যায়। তিনি বলেন, গত ১০ বছরে কমপক্ষে ৩৮টি আন্তর্জাতিক বা গৃহযুদ্ধে নারীদের জড়িত হতে দেখা গেছে এবং মোট যোদ্ধার শতকরা ১০ থেকে ৩০ ভাগ নারী। সর্বশেষ সিরিয়ার আইএস যুদ্ধে যোগ দেওয়া বিদেশি যোদ্ধাদের মধ্যেও ১০ ভাগ নারী।
গবেষক বার্গার ও চ্যুলিকস্যানকস ২০০৭ সালে মিশরীয় ইসলামী এক চিন্তাবিদের ফতোয়া তুলে ধরেন এভাবে, ‘যখন শুনি শত্রুশিবির একটি মুসলিম ভৌগোলিক অঞ্চলে তখন সকল মুসলিম জাতি জণ-গোষ্ঠীর দায়িত্ব পরে শত্রুশিবিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। স্বামীর মতামত বা সিদ্ধান্তের বাইরেও এমনকি নারীদের যুদ্ধে যাওয়া উচিত।’ কার্লা জে. ক্যানিংহাম নামে বিখ্যাত এক গবেষকও প্যালেষ্টাইন যুদ্ধে নারীদের ব্যবহার বিষয়ে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর ফতোয়া ও মতামত তুলে ধরেন। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল সংগঠনগুলোতে নারী ফ্রন্ট ও অভ্যন্তরীন শাখা খোলা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনসমূহের মধ্যে হিজবুত তাহরীরের ছাত্রী মুক্তি সংস্থা, জামাত ইসলামী বাংলাদেশের ইসলামী ছাত্রী সংস্থা, নব্য জেএমবির অধীনে শহীদ হামজা ব্রিগেড ও ব্যাট উইমেন নামে ফ্রন্ট ক্রিয়াশীল আছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ভাবাদর্শিক ভরকেন্দ্র হিসেবে আল কায়েদার সাথে যুক্ত সংগঠনসমূহের নারী সংগঠন ছিলোনা যেখানে আইএস এর সাথে যুক্ত সংগঠনগুলোতে নারী সংগঠন ক্রিয়াশীল। যেমন হরকাতুল জিহাদ আল বাংলাদেশ (হুজি) নামে সংগঠন সমূহের কোন নারী সংগঠন ছিলোনা।
এসব ক্রিয়াশীল সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারী জঙ্গিরা দাওয়াত কার্যক্রম, জঙ্গি সংগঠনসমূহে সদস্য সংগ্রহ, জঙ্গি হামলা যুক্ত ও অপারেশন পরিচালনা করার প্রশিক্ষণ এবং আত্নঘাতী বোমা হামলার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। জঙ্গি কার্যক্রমের প্রাথমিক পর্যায়ে নারীরা ইসলামী দাওয়াত, পাঠচক্র, কোরান-সুন্নাহ পাঠ থেকে শুরু করলেও বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রযুক্তি বিশেষত মোবাইল এ্যাপসের পাশাপাশি বিভিন্ন ইন্টারনেট লিংক ব্যবহার করেন।
পুলিশের কাছে গ্রেপ্তারকৃত নারী জঙ্গিদের জবানবন্দী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, পুলিশ কর্মকর্তা ও ট্রান্সন্যাশনাল ও টেরোরিজম ক্রাইম ইউনিট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতামত হতে জানা যায় যে, বর্তমানে নারী জঙ্গিরা ‘বাইয়্যাত ও দাওয়াত কার্যক্রম’ ‘আত তামকিন’ ‘উম্মু জনদুল্লাহ হুরাইয়া’ ‘ব্লাক রোজ’ ‘ইসলামী ক্লাস ফর গার্লস রোজ’ নামে লিংক ও ফ্রিমা মোবাইল এ্যাপস ব্যবহার করে ইসলামী খেলাফত, আইএস ও বিভিন্ন জঙ্গি ও গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেয়। বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে ঢাকার আশকোণা, রাজশাহীর গোদাগড়ি, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে গ্রেপ্তারকৃত নারীদের মধ্যে নাবিলা, লীনা, সাদিয়া আমিনসহ মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের তিন বান্ধবীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে তা পুরোপুরি মিলে যায়।
নারী সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে গবেষণার একটা বড় স্থান দখল করে আছে কার্যকারণ উদঘাটনের প্রশ্নটি নিয়ে। অপরাধবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের একক কারণের বাইরে বহুমূখী ও স্বমন্বিত দৃষ্টিকোণ থেকে তা বিচার করার প্রবনতা আছে। কেউ কেউ একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়কে সামনে আনেন যেখানে অনেক গবেষকই সামাজিক, পারিবারিক, ভাবাদর্শ ও রাষ্ট্রীয় কারণগুলোকে ফোকাস করেন। সন্ত্রাসবাদ গবেষক নিওবার্গার ও ভ্যালেন্টাইন প্রচলিত অর্থে নারীর স্যাক্রিফাইস বা আত্নত্যাগকে সামনে আনেন যেখানে ভিক্টর নামে আরেকজন ব্যক্তিগত ও অভ্যন্তরীণ কারণকে সামনে আনেন।
মিয়া ব্লোম নামে একজন সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ নারী জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসীদের ব্যক্তিগত মূল্যায়নসহ পরিবারের মর্যাদা, খুনের বদলা খুনের মতো প্রতিশোধস্পৃহা এমনকি পরকীয়ার মতো বিষয়কে সামনে আনেন। বাংলাদেশে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারকৃতদের হিজবুত তাহরীর, নব্য জেএমবি, আল্লার দলের অনেক নারী কর্মীরাও তাদের স্বামীর খুন, গ্রেপ্তার, ক্রসফায়ারের কারণে যুক্ত হয়েছেন বলে তাদের স্বীকারোক্তিতে বলেছেন। এদের অনেকেই কোন না কোনভাবে পারিবারিকভাবে জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত থাকা পুরুষ সহকর্মী, বন্ধু, স্বামী, ভাইয়ের হাত ধরে এসেছেন বলে জানা যায়। তামিম চৌধুরি, শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইসহ এখনকার সময়ে যারা বিভিন্ন মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গি সংগঠনে কাজ করেন তাদের অনেকের পরিবারের নারী সদস্যরাই নারী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ছাত্রী মুক্তি সংস্থা, ব্যাট উইমেন এবং শহীদ হামজা ব্রিগেডে কাজ করছেন। কার্লা জে. ক্যানিংহ্যাম সূনির্দিষ্টভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক কারণের পাশাপাশি অনেক সময়ই ভাবাদর্শ, জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা-সংগ্রাম এবং সমতার চিন্তা কিভাবে জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হতে প্রভাবিত করে তা তুলে ধরেন। বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যেমন প্যালেষ্টাইন যুদ্ধ, চেচেন বিদ্রোহ, এলটিটিই, আলজেরীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মতো বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত নারীদের ক্ষেত্রে এই চিন্তার অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মীয় সংগঠনসমূহে নারীদের যুক্ত থাকার বিষয়টির সাথে সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী ইসলামীকরণ ও বিশেষভাবে বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতিতে ভাবাদর্শের প্রয়োগ-প্রসারের উপর নির্ভর করেছে বলে আমার মনে হয়। আগেই উল্লেখিত বিভিন্ন দাওয়াত কার্যক্রম, প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে হোলি ওয়ার কিংবা পবিত্র যুদ্ধের গল্প ও বীর সেনানীদের যে আপাত মিথ তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে বলে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।
এখানে ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত থাকা নেতা-কর্মী, সংগঠকদের জীবনী, কর্মসূচি, কর্মপ্রক্রিয়া ও আন্দোলনের তথাকথিত মর্যাদাপূর্ণ ইতিহাস তাদের প্রভাবিত করে বলে জানা যায়।
সন্ত্রাসবাদ দূরকরণে অন্যান্য দেশগুলোতে সম্বন্বিত পদ্ধতি ব্যবহারের উদাহরণ থাকলেও বাংলাদেশ সরকার এখনো বিচারবিভাগ বিশেষ করে পুলিশের ভূমিকার উপরই নির্ভরশীল। যেহেতু সন্ত্রাসবাদের কার্যকারণ বহুমূখী ও সম্বন্বিত সেহেতু নারী জঙ্গিদের সন্ত্রাসবাদ দূরকরার স্ট্রাটেজিও বিভিন্নমূখী এবং সম্বন্বিত হওয়া উচিত।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি দাওয়াতী কার্যক্রমে জঙ্গিবাদ উপাদান চিহ্নিতকরণ, মগজধোলাই কর্মসূচি বিপরীত কার্যক্রম, জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্ক সাইট নিষিদ্ধকরণ, গ্রেপ্তারকৃতদেন নবতর জীবনবোধ তৈরির স্বল্পমেয়াধী আশু কর্মসূচি নিতে হবে।
সন্ত্রাসবাদের পথে নারীর বিপদযাত্রা ঠেকাতে হলে পুরুষতন্ত্রের রাজনীতির সামনে দাঁড়াতে হবে বারবার। যেখানে পুরুষ ধর্ম তৈরি করেছে আর নারী সেই ধর্ম পালন করেছে বিনা বাক্য ব্যয়ে। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সামজিকীকরণে স্বামীর প্রতি আনুগত্য, স্বামীর আদেশ পালনের শিক্ষা নারীরা পায় শৈশবে। এখানে “স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত” হাদিস প্রচার করেছে পুরুষ যা অনেক নারীর কাছেই ভয়ঙ্কর জনপ্রিয়। অন্যদিকে, সমাজজুড়ে নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজ করছে এক পাহাড় সমান সামাজিক বৈষম্য ও অসমতা। নারীর যে প্রান্তিক অবস্থান তা থেকে কেন্দ্র তুলে আনতে প্রয়োজন শিক্ষার উন্নতি, অন্তর্ভূক্তিকরণ নীতিমালা। সেই সাথে বি-ইসলামীকরণের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার দিকে সরকারের দৃষ্টি ফিরাতে হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সরকার, নীতি নির্ধারক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও গবেষকদের সমন্বিত কার্যক্রম জরুরি। তাহলেই দীর্ঘমেয়াদে সন্ত্রাসবাদ,বিশেষ করে নারী সন্ত্রাসবাদ দূর করা সম্ভব হবে।