জ্ঞানী লোকের হীনমন্যতা

সামনের  মাসে ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন হওনের কথা ছিল, সেইটা কিভাবে ভেস্তে গেল এই নিয়া বিভিন্ন কেচ্ছা কাহিনী পড়লাম। এইসব কেচ্ছাকাহিনীর কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা সেইটা নিয়া আমার কোন চিন্তাভাবনা নাই। কিন্তু একটা জিনিস নিয়ে বেশ মজা পাইলাম। সেইটা হইতেছে, বেশ কয়েকজন অভিযোগ করছে ফরহাদ মজহার প্রথম আলো তথা সাজ্জাদ শরিফ গ্রুপের লোকজনকে এই সম্মেলনের কমিটিতে পুশ করনের কারনে বিভিন্ন মনোমালিন্য তৈরী হইছে। ফরহাদ মজহার চাইতেছিলেন প্রথম আলো গ্রুপের লোকজনকে এর সাথে ভালোভাবে যুক্ত করতে , কয়েকজন সেইটার আবার বিরোধিতা করেছেন।ফরহাদ মজহারের পোস্ট মর্ডার্ণচিন্তাভাবনার এক নাম্বার বৈশিষ্ট্য হইতেছে প্রতিষ্ঠিত কর্পোরেট মিডিয়ার প্রতি সন্দেহ এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সেইটা যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাইলে তিনি আবার প্রথম আলো গ্রুপের লোকজনকে লইয়া দৌড়াদৌড়ি করতেছেন কেন? স্ববিরোধী হয়ে গেল না?

ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন যে হবে না, হইলেও দর্শক সাড়িতে একটা লাইনও পুরা হবে না, সেইটা আমার বিশ্বাস। এই বিশ্বাস অবশ্যই পর্যবেক্ষণ থিকা আসছে। অনেকে বলেন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যাপিটাল মেলা। খালি মিসম্যানেজমেন্টের জন্যে হইতেছে না কিছু। আমার মনে হয় ঘাপলা অন্যখানে। আমাদের আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যাপিটালই কম। ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাপার স্যাপার নিয়া যেরকম প্যাশন থাকনের কথা সেইটা এই অঞ্চলে এক কালে হয়ত ছিল, এখন বেশ দুর্লভই মনে। এর পিছনে অবশ্যই আর্থসামাজিক কারন আছে।

আমরা আশা করি লেখকেরা টেকাপয়সার ব্যাপারে উদাসীন থাকবেন। শিল্পের প্রতি ভালোবাসার কারনে তারা মহান দারিদ্র্যের জীবন যাপন করবেন। তারা টেকার কাছে বিক্রি হবেন না। এখন কথা হইতেছে একজন মানুষের জীবন যাপনের জন্যে তো ট্যাকা পয়সা লাগে। তাইলে একজন লেখক যদি শুধুমাত্র শিল্পের প্রতি ভালোবাসার কারনে লেখেন, তাইলে তার আরামে থাকনের জন্যে যেই ট্যাকা লাগব, সেই ট্যাকা কি সমাজ বহন করবে? সেইটা তো করবে না।

মানুষের আরামে জীবন যাপনের ইচ্ছার মাঝে কোন ছোটলোকি নাই। ফরমায়েশী লেখারো তাই কোন ছোটলোকি নাই। বুদ্ধিবৃত্তিক জিনিসপত্রকে তাই জৈবিক জীবন থিকা আলাদা করে ইন্টেলেকচুয়াল প্লেইনে রাখন ঠিক না।

এই দেশের জ্ঞাণী লোকরা তাই ভিষণ হীন্মন্যতায় ভোগেন। তারা দেশ এবং পৃথিবী সম্পর্কে বিপুল জেনেও একজন ইন্টেলেকচুয়ালি ইনফেরিয়র ব্যাংকার কিংবা অন্য পেশাজীবির চেয়ে অনিশ্চয়তার সাথে কষ্টকর জীবন যাপন করেন। তারা বাসে ঝোলেন। তারা বৃষ্টিতে ভেজেন। অন্যদিকে দেরিদার নাম না জানা ব্যাংকার মার্সিডিজ হাঁকান।

দারিদ্র্য কোন মহান জিনিস না। এইটা মানুষের স্থিরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট করে। নিজের মধ্যে একধরনের “শহীদ” প্রবণতা তৈরী করে। উইনার বাসে ঝুলতে ঝুলতে এই দেশের একজন পোস্ট মর্ডানিস্ট দার্শনিকের মনে তাই বাসের বাইরে দেখা মার্সিডিজ দেইখা একধরনের ডিফেন্স ম্যাকানিজ ইনভোকড হয়। সে ভাবে , “আমার দরকার নাই গরমে এসির হাওয়া খাওন, ঐ শালা কি জানে মিশেল ফুকো কিভাবে দেখাইছেন, এইসবের কোন মানে নাই”?

বুদ্ধিবৃত্তি নিয়া এই গর্বের ভাবটা না গেলে অবস্থার উন্নতি হবে না। আর এই গর্বের ভাবটা মনে হয় তখনই যাবে যখন, একজন ইন্টেলেকচুয়াল তার পছন্দের জিনিসপত্র চর্চা করেই আরামে জীবনযাপনের পথ পেয়ে যাবেন। নাইলে কিছুই হবে না।

ফরহাদ মজহার কিংবা অন্য যারা এই সাহিত্য সম্মেলন নিয়া কাইজ্জা করতেছেন, তা দেখে আসলে অবাক হওনের কিছুই নাই। তবে ফরহাদ মজহারের প্রথম আলোর লোকজন প্রীতির কারনটা জানতে ইচ্ছে করে। এইটা কি শুধু মাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্যে নাকি দার্শনিক কারন আছে এর পেছনে?

You may also like...

Read previous post:
সেনাবাহিনী বনাম তনু

রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ যদি অপচয় করা হয় সেটাকে বলে রাষ্ট্রীয় অপচয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় অপচয়টি হয় হর্তা-কর্তাদের দুর্নীতির...

Close