বাংলাদেশ মানুষ চরিত

বাংলাদেশে খবর নিয়ে আমি আগ্রহ হারিয়েছি অনেক আগেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা দেশপ্রেমিক মানুষ না। “দেশ” ধারনাটাই আমার কাছে সুপারফিশিয়াল , অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিকর মনে হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবাদ এবং সংবাদ বিশ্লেষণ উভয়েই এত নিম্নমানের যে এইগুলো ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদদের ছাড়া বর্তমান মানুষের বিশেষ কোন কাজে আসে না।

বাসায় পত্রিকা রাখা হয় দেখে মাঝে মাঝে একটা দুইটা খবর চোখে পরে। টিভি দেখা বাদ দিয়েছি অনেক দিন হল। সেকারনে অনেক সময়ে দেশের বর্তমান চালু ঘটনা আমার দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়।

শিশুটি সেদিন কূপে পরে যাওয়ার নিরন্তর সরাসরি সম্প্রচারের ধাক্কায় আমার বাপ/মা ড্রয়িং রুমেই মোটামুটি আবাসন গেড়েছিল। আল জাজিরায় হেড টু হেড এ বিখ্যাত একজন ডানপন্থী অর্থনীতিবিদ আর্থার লাফের এর পর্বটা রাতে দেখানোর কথা ছিল। ড্রয়িং রুমে গভীর রাতেও বাপ/মা কে বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ আমিও লাইভ টেলিকাস্ট দেখলাম।

আমাদের দেশে মৃত্যু এবং দুর্ঘটনা এই দুই-ই খুব সহজ ব্যাপার। প্রতিদিনই ঘটছে। ঢাকার মধ্যে হওয়াতে লাইভ টেলিকাস্ট পেয়েছে। নাহলে পেত না। প্রতিবছর যে গণ্ডাখানেক লঞ্চ ডুবে মানুষ মারা যায়, সেই মৃতদের তালিকায়ও শিশু থাকে। সেগুলো লাইভ টেলিকাস্ট হয় না। তাই সেই মৃত্যুর মিছিল আমাদের কাছে শুধুই সংখ্যা।

এই লাইভ টেলিকাস্টের একটি অন্তত ভালো দিক ছিল। সেটি হচ্ছে, নৈশপ্রহরীর ছেলে, যার ভাগ্য হচ্ছে সমাজের উচ্চবর্গের দ্বারা ডিহিউম্যানাইজড হওয়া, সেই ছেলে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও রক্তমাংশের মানুষ হয়ে উঠেছিল আমাদের চোখে। তার জন্যে কষ্ট পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। অন্যথায় নিম্নবর্গের মানুষ আমাদের সমাজে প্রধানত সেগ্রেগেটেড এবং ডিহিউম্যানাইজড। তাদের জন্ম মৃত্যু সুখ দুঃখ সবই আমাদের কাছে কেবলই সংখ্যা, এর বেশী কিছু নয়।

এই পুরো ঘটনায় আমার আগ্রহের বিষয় আসলে উদ্ধারকাজের উন্নতি কিভাবে সম্ভব সেই নিয়ে নয়। এই প্রতিটি দুর্ঘটনায়ই প্রমাণ হয় আমরা জাতি হিসেবে ইনকমপিটেন্ট। নতুন কিছু প্রমানের কোন সুযোগ নেই। যেহেতু আমাদের দেশে পলিসি তৈরীতে পাবলিক পার্টিসিপেশনের হার শুন্য সুতরাং এইসব নিয়ে দৌড়াদৌড়িরও কোন লাভ নেই। পাবলিক পার্টিসিপেশন মানে শুধু ভোট দেয়া নয়। এখন ভোট দেয়াটাও গোল্লায় গেছে যদিও, সেটা না হলেও পাবলিক পার্টিসিপেশন মূলগতভাবে পরিবর্তন হত না। সুতরাং পরবর্তী দুর্ঘটনার জন্যে এইসব উন্নয়নমূলক কথাবার্তা মূলতবি রাখাই স্বাস্থ্য এবং মনের জন্যে ভালো।

আমার মজা লাখছিল পাবলিক ওপিনিয়ন কত দ্রুত শিফট করে সেটি দেখে। সকাল বেলা চা খেতে গিয়ে শুনলাম একটা। অফিসে গিয়ে শুনলাম আরেকটা। বাচ্চার মৃতদেহ উদ্ধারের পর শুনলাম আরেকটা।

তথ্যের উতস এবং গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকা এবং সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেকোন যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষ এই প্রশ্ন তুলতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে তোলা উচিত। কিন্তু এর মানে এই নয়, একটি তথ্যকে সন্দেহ করে আরেকটি প্রমানহীন অনুকল্প গ্রহন করা। অথচ এটি হচ্ছে এই অঞ্চলের প্রধান কাজ।

কোন তথ্য আমাদের কাছে পৌছানোর সাথে সাথে আলোর গতিতে আমরা “মোটিভ” বুঝে ফেলে নতুন একটি কাঠামো তৈরী করে ফেলি। সকাল সন্ধ্যা ষড়যন্ত্র তত্ব তৈরী করে আমাদের দিন কাটে। আমরা মানুষের মন বুঝতে এতটা পারঙ্গম যে অধিকাংশ সময়ে নতুন ষড়যন্ত্র তত্ব উদঘাটনের সময় আমাদের নতুন তথ্য উপাত্ত কিছুই লাগে না।

সমাজে মতামত কিভাবে ছড়ায় এই নিয়ে বেশ কিছু গাণিতিক মডেল আছে। সকাল থেকে ঘাটাঘাটি করছিলাম মিডিয়া তথা টিভি/সংবাদ পত্র কিভাবে মানুষের অপিনিয়ন শেইপ করে সেই সম্পর্কে কোন মডেল পাওয়া যায় কিনা। একটা পেলাম[১]। বাংলাদেশে এই মডেল প্রয়োগ করা যায় কিনা সেটা আমার দেখার ইচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের কেইসটা খুব বেশী ইউনিক। আমরা অপিনিয়ন শেইপ করতে তথ্য প্রমাণের ধার ধারি না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এমনকি বর্তমানে পরিস্থিতি দাড়িয়েছে এমন যে মিডিয়া যদি কোন তথ্যকে প্রমোট করতে চায়, মানুষ সেই তথ্যকে প্রতিরোধ করার জন্যে স্বতপ্রণোদিতভাবে কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরী করে। অপিনিয়ন ডাইনামিক্স এই কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরী প্রবনতা কখনও ভেবে দেখা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। সাধারনত মিডিয়া হেজেমনিই বারবার আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অন্তত একটি বড় প্রবণতা তৈরী হয়েছে মিডিয়ার তথ্যকে শুধুমাত্র অস্বীকার না করে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যারেটিভ তৈরী করা, অবশ্যই তথ্য উপাত্ত ছাড়াই অধিকাংশ ক্ষেত্রে।

 

You may also like...

Read previous post:
স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার

পুলিশের বুকে এখন আর নেম প্লেট দেখাই যায় না। অধিকাংশ সময়ই তারা নেমপ্লেটটি খুলে রাখছে। নীতি নৈতিকতা হারাতে হারাতে এখন...

Close