নাটেরগুরু যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম
যুদ্ধাপরাধের নাটের গুরু গোলাম আযম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির কাছে এক পৈশাচিক নাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই নরপশুর নাম আজীবন ঘৃণা ভরে মানুষ স্মরণ করে যাবে। সকল যুদ্ধাপরাধের শিরোমণি এই গোলাম আযম ১৯৭১ সালে যে জঘন্য, বর্বর গণহত্যার নীল নকশা করেছিলো তার অপরাধের বর্ণনা শুনে আজও গা শিউরে উঠে।
আজকে আপনাদেরকে এই নরঘাতক গোলাম আযম এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে মানবতাবিরধী অপরাধের সকল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানাতে চাই। এই প্রজন্মের যারা এই রাজাকারকে ইসলামী আদর্শের নেতা বলে ভাবেন এবং তাকে নিরাপরাধী মনে করেন তাদের উদ্দেশ্যে আমার এই লেখা। আশা করছি এই প্রজন্মর ভণ্ডামির বেড়াজাল থেকে বের হতে আমার এই লেখা আপনাদের কে সাহায্য করবে।
রাজাকার গোলাম আযমের জন্ম ও রাজনৈতিক জীবনঃ
১৯২২ সালের নভেম্বরের ৭ তারিখ ঢাকার লক্ষ্মীবাজারস্থ মামার বাড়ি শাহ সাহেব বাড়িতে এই কুখ্যাত রাজাকারের জন্ম হয়। গোলামের পিতা গোলাম কবির আর মাতা সৈয়দা আশরাফুন্নিসা। গোলাম নিজ গ্রাম কুমিল্লার বিরগাও এর এক মাদ্রাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। এরপর ঢাকায় এসে উচ্চ মাদ্ধমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর উপর বি এ এবং ১৯৫০ সালে এম এ ডিগ্রী লাভ করে।
পড়াশোনা শেষ করেই ১৯৫৪ সালের দিকে গোলাম সাঈদ আল মওদুদীর ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া শুরু করে এবং এর সুত্রপাত ধরে ১৯৫৪ সালের ২২ এপ্রিল গোলাম জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে তাবলিক-ই-জামায়েতের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করে। জামায়েত ইসলামীতে সহযোগী (মুত্তাফিক) থাকার সময় ১০৫৫ সালের দিকে গ্রেফতার হয় রংপুরের কারাগারে বন্দী থাকে এবং বন্দী থেকেই জামায়েতের রুকন হয়। ১৯৫৫ সালের জুন মাসের দিকে রাজশাহী বিভাগের জামায়েত ইসলামের সেক্রেটারি হয়ে যায় এই রাজাকার। বছর ঘুরতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জামায়েত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি আর রাজশাহী বিভাগীয় আমিরের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই শয়তান পদোন্নতি লাভ করা শুরু করে এবং ১৯৫৭ সালের মধ্যেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়েত ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক হয়ে যায়।
কিন্তু ১৯৬৪ সালে গোলাম আযমকে মৌলবাদী ধর্মীয় কাজ কর্মের জন্য গ্রেফতার করে প্রশাসন। আইয়ুব খান জামাতি ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আট মাস কারাগারে বন্ধী থাকে এই রাজাকার। কিন্তু এই সুচতুর গোলাম ঠিকই ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জামায়েতে ইসলামীর আমীর অর্থাৎ সভাপতির দায়িত্ব দখল করে ফেলে। এই ক্ষমতা দখলের পর থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধ গুলোর নেতৃত্ব দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধের শিরোমণি এই নরপশু গোলাম আযম। গোলাম ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক জোট গঠনের অন্যতম অংশগ্রহণকারী ছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জামায়েত ইসলামের আমীরের পদ ধরে রেখেছিল এই নাটের গুরু গোলাম আযম। তাই জামায়েত ইসলামের সকল নেতার গুরু হিসেবেই এই নরপশু পরিচিত ছিল। (সুত্রঃ Hossain, N. Siddiquee, ‘Islam in Bangladesh Politics: the role of Ghulam Azam of Jamaat-i-Islaami’, Inter-Asia Cultural Studies, Vol 5, 2004, p. 385)
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে গোলামের কারনামাঃ
ধর্মীয় গোঁড়ামি আর মৌলবাদের আঁকড়া জামায়েত ইসলামীর আমীর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম বরাবরই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতো। এই নরঘাতক কোনভাবেই চায় নি বাংলাদেশ স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। এই জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম আযম এর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামীলীগ কে ষড়যন্ত্রকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে। মুজিবনগর গঠনের পর ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাক দেন, তার পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু জামায়েতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে ২৫ মার্চ এর পর থেকে এই রাজাকার গোলামের বিভিন্ন ধরনের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মন্তব্য নিয়মিত প্রকাশ পেতে শুরু করে। ২৫ মার্চ সেই ভয়াল রাতের নিরাপরাধ মানুষদের হত্যাযজ্ঞ শেষ হবার ঠিক ৬ দিন পর রাজাকার গোলাম ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে একটা ভাষণ দেয়। ভাষণে মৌলবাদী আগ্রাসন থেকে সুরু করে ভারতের কড়া সমালোচনা করে বলে,
‘‘ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করছে। আমি বিশ্বাস করি যে, আমি বিশ্বাস করি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের নিকট হতে কোন প্রকার সাহায্য পাবে না।’’
২০ জুন, ১৯৭১ সালে গোলামের এক বক্তব্য পাকিস্তানের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন পুনুরাব্যাক্ত করে বলে, “পাকিস্তনি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় সকল সন্ত্রাসীদের হটিয়ে দিয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধকে গুলাম আযম ভারতের ষড়যন্ত্র বলে মনে করতো। তাই ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল শান্তি বাহিনী গঠন করা হয়। ১২ এপ্রিল গোলাম আযম এবং আর এক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ওরফে মইত্যা রাজাকার মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যাইত করে একটি বিক্ষোভের ডাক দিয়ে এর নেতৃত্ব দেয়। শান্তি বাহিনী মুলত মুক্তিযুদ্ধে বর্বরতম রাজাকার বাহিনী ছিল এবং গোলাম আযম এই বাহিনীর অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা। গোলাম আজমের জামায়েত ইসলামী, মুসলিম লীগ ও বিহারীদের কে নিয়ে গঠিত হয় শান্তিকমিটি। এবং এই রাজাকারদের গুষ্ঠি শান্তি কমিটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের প্রত্যক্ষ ভাবে সকল মানবতাবিরধী অপরাধ সংঘটনে অংশ নিত এবং সাহায্য করতো। এই রাজাকার গোষ্ঠী তাদের মূল কর্মকাণ্ডের লিস্ট এর মধ্যে স্থানীয় হিন্দু পরিবারদের যত সম্পদ, জমি, ভিটা-মাটি দখল করে সেগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিত। মুক্তিবাহিনী, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের,আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে রাস্তায় হানা দিত, তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা জানার জন্য নানা ভাবে অত্যাচার এবং হয়রানি করতো। মেয়েদের কে ধরে নিয়ে যেত। এবং গ্রামে গ্রামে গিয়ে এরা রাজাকার সদস্য সংগ্রহ করতো। রাজাকার বাহিনীর জন্য গোলাম আযম তার জামায়েত ইসলামী দল থেকে ৯৫ জন সদস্যকে বাছাই করে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করে। যাদেরকে খুলনায় শাহজাহান আলী সড়কের আনসার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দেয়া হয়েছিল অস্ত্র। জবাই করে মানুষ মারতে হবে কি করে তাও শেখানো হয়েছিল। গুলি যাতে কম খরচ হয় তাই জবাই করে মানুষ খুন করার বিভিন্ন নিয়ম শেখানো হতো ওই ক্যাম্পে। এছাড়া গোলামের নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়েতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান আশরাফ হোসাইন জামালপুর জেলায় আলবদর বাহিনী গঠন করে।
যুদ্ধকালীন সময়ে গোলাম প্রায় গোপন বৈঠকের জন্য পাকিস্তানে চলে যেত। সেখানে গিয়ে যুদ্ধের সকল খবর এবং রাজাকার বাহিনী দ্বারা পরিচালিত সকল নৃশংস হত্যা কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করতো। পাকিস্তানি নেতাদের নিয়ে যুদ্ধ সম্পর্কিত আলোচনা করতো। ১৯৭১ এর ৩০ এ জুন পাকিস্তানের লাহোরে সাংবাদিকদের কাছে গোলাম আযম বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ও স্বাধীনতাকামী মানুষদের দেশদ্রোহী এবং দুষ্কৃতিকারী বলে উল্লেখ করে, এবং এদেরকে সমূলে নির্মূল করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। আমরা যুদ্ধ করছি। এই যুদ্ধে দুষ্কৃতিকারীদের হাতে আমাদের জামায়েত ইসলামের বহু নেতা শহীদ হয়েছেন। ( সুত্রঃ “লাহোরে সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপক গোলাম আযম (Prof. Ghulam Azam in a conference at Lahore)”। Daily Sangram। জুন ২১, ১৯৭১)। গোলাম আযম অয়াকিস্তান সেনাবাহিনী জেনারেল টিক্কা খান এবং অন্য অফিসারদের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে বানচাল করা যায় তার গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল। বাংলাদেশ থেকে এদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহনের জন্য বিশদ ভাবে আলোচনা করে। (সুত্রঃHistory speaks up – Julfikar Ali Manik and Emran Hossain”। The Daily Star। অক্টোবর ২৭, ২০০৭।)
রাজাকার গোলাম আযম ৭১ এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল। এই জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়। জানা যায় সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে রাও ফরমান আলীর সাথে এক গোপন বৈঠক করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীল নকশা তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হবার সম্ভাবনা যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিল এই গোপন বৈঠকের পরিকল্পনায় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রামে গোলাম আযমের পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালের একটি সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ দুই কিস্তিতে ছাপা হয়। এই সাক্ষাৎকারে রাজাকার গোলাম মুক্তিবাহিনীর সাথে তার দলের সদস্যদের সংঘর্ষের বিভিন্ন বিবরণ ও পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থতির ওপর মন্তব্য করে বলে,
“বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামায়াতকে মনে করতো পহেলা নম্বরের দুশমন। তারা তালিকা তৈরি করেছে এবং জামায়াতের লোকদের বেছে বেছে হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর লুট করছে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এতদসত্বেও জামায়াত কর্মীরা রাজাকারে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে ‘বাংলাদেশ’ ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কোন স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না।” (দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে, রাজাকার গোলাম আযমের করা উক্তি সমূহঃ
১৯৭১ সালে তৎকালীন সময় জামায়েত ইসলামের মুখপত্র ছিল দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা। আর এই পত্রিকায় রাজাকার গোলাম আযমের দেয়া বিবৃতি সহ যে সব খবর গুলো প্রকাশ করেছে তার থেকে সংকলিত কিছু বিবৃতি তুল ধরলাম আপনাদের কাছে।
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা-
গো আযমের যুক্ত এক বিবৃতিতে সঙ্গে ছিলেন মওলানা নুরজ্জামান, তিনি একাত্তরের জামায়েত ইসলামীর প্রচার সম্পাদক ছিলেন সাথে ছিল জামায়াতের অন্যতম নেতা গোলাম সারওয়ার সেখানে গোলাম আযম বলে- ‘ভারত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। ভারতীয় বা পাকিস্তান বিরোধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারী যেখানেই যাবে, সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের দেশ প্রেমিকরা তাদের নির্মূল করবে।’
১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল, শুক্রবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
গো আযম মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তনে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে ভারত প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশপ্রেমের মূলে আঘাত হেনেছে। এ ধরনের অনুপ্রবেশ এ প্রদেশের মুসলমানদের কাজেই আসবে না।’
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, শনিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
গোলাম আযম জামায়েত ইসলামীর ছাত্র সংঘের এক বিবৃতিতে বলে, ‘দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীদরে হাত থেকে পূণ্য ভূমি পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ছাত্র সংঘের প্রতিটি কর্মী তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে যাবে। হিন্দুস্তানের ঘৃণ্য চক্রান্তের দাঁতভাঙা জবাব দেবার জন্য ছাত্র সংঘ কর্মীরা সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল, সোমবার,বায়তুল মোকাররম, বাংলাদেশ
বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে থেকে গোলাম আযম নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম মিছিল বের করে। মিছিলে ব্যাবহার করা পোস্টার, ফেস্টুনে লেখা ছিলো “দুষ্কৃতিকারীরা দূর হও” “মুসলিম জাহান এক হও” “পাকিস্তানকে রক্ষা কর”। “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আযম জিন্দাবাদ।”পাকিস্তানের উৎস কি- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ।” “মিথ্যা প্রচার বন্ধ কর। “ব্রাক্ষ্মবাদ নিন্দাবাদ, সাম্রায্যবাদ মূর্দাবাদ” । মিছিলে পাকিস্তানের জন্য মুনাজাতও করেন গোলাম আজম।
১৯৭১ সালের ১৩ মে বৃহস্পতিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
জামায়েত ইসলামী ছাত্র সংঘের এক বিবৃতিতে গো আযম বলে, ‘দেশের বর্তমান দুরবস্থার জন্য ছাত্রসমাজকে দায়ী করা হয়। অথচ ছাত্র সংঘের কর্মীরাই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন ও (পাকিস্তান) সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে বেশি তত্পর। ছাত্র নামধারী ভারতের সাম্রাজ্যবাদের যে সমস্ত চর তথকথিত “বাংলাদেশ”-প্রচারণা চালিয়েছিল তারা ছাত্র সমাজের কলঙ্ক। তাদের জন্য সমুদয় ছাত্র সমাজকে দায়ী করা ঠিক নয়।’
১৯৭১ সালের ১৭ জুন বৃহস্পতিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
জামায়েত ইসলামের ছাত্র সংঘের নেতা গো আযম বিবৃতি দিয়েছিল, ‘দুষ্কৃতিকারীরা এখনও তাদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করা। পূর্ব পাকিস্তানের এমন নিভৃত অঞ্চল রয়েছে যেখানে দুষ্কৃতকারীরা জনগণকে পাকিস্তান রেডিও শুনতে দেয় না।
১৯৭১ সালের ১৯ জুন, শনিবার, লাহোর, পাকিস্তান
রাজাকার গোলাম আযম প্রেসিডেন্ট ইহায়িহা খানের সাথে বৈঠক শেষে বলে, “কেবলমাত্র দেশপ্রেমিক জনগনের সাহায্যে দুষ্কৃতিকারীদের প্রতিহত করা যেতে পারে। এই দেশ প্রেমিক বলতে এ রাজাকার, আল বদর, আস শামস কেই গোলাম আযম বুঝিয়েছে।
১৯৭১ সালের ২০ জুন রবিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
লাহোরের বিমানবন্দরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখে গোলাম আযম। বক্তব্যে বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে অধিক সংখ্যক অমুসলমানদের সহায়তায় শেখ মুজিবুর রহমানের হয়তো বিচ্ছিন্নতার ইচ্ছা থাকতে পারে। অবশ্য তার ছয় দফা স্বাধীনতাকে সম্ভব করে তুলতে পারত।সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সকল দুষ্কৃতকারীদের উত্খাত করেছে এবং বর্তমানে এমন কোন শক্তি নাই যা সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’
১৯৭১ সালের ২২ জুন মঙ্গলবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
রাজাকার গোলাম আযমের এক সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হয় এই দিনে। সেখানে এই রাজাকার বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা ইসলামকে কখনও পরিত্যাগ করতে পারে না। এ কারণে তারা পাকিস্তানকেও ত্যাগ করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তান ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দুষ্কৃতিকারী ও রাষ্ট্র বিরোধী হিসেবে আখ্যা দেয় এই নরঘাতক।
১৯৭১ সালের ২৩ জুন বুধবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
এই দিনে ছাত্র সংঘের এক কর্মিসভায় গো আযম বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানিরা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদের সাথে একত্রে বাস করবে। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। যেসব দল খোলাখুলিভাবে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন শুরু করেছিল এবং স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য জনতাকে উত্তেজিত করেছিল সেসব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য এই গো আযম সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।’
১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট মঙ্গলবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
মাদ্রাসার এক শিক্ষা সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, ‘এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, আদর্শিক যুদ্ধ। আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই দেশকে বাঁচিকে রাখার জন্য যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।’
২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইট এর বর্বরোচিত হামলা সম্পর্কে গোলাম আযম বলে, ‘২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা ছিল এদেশের মাটি রক্ষার জন্য।’
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর শুক্রবার, রাওয়াল পিন্ডি, পাকিস্তান-
আলবদর আলশামস শান্তি কমিটির রাজাকারদের প্রশংসা করে এই গোলাম আযম বলে, যদি তাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে দেয়া হয়, তাহলে তারা দুষ্কৃতিকারীদেরকে নিজেরাই খতম করে দিতে পারবে।
১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর শনিবার, রাওয়াল পিন্ডি, পাকিস্তান-
পাকিস্তান সরকারকে গো আযম আশ্বস্ত করে বলে, আমরা দুষ্কৃতিকারী বিচ্ছিন্নবাদীদের বিরুদ্ধে সরকারের সাথে সহযোগিতা করছি।
১৯৭১ সালের ১ লা ডিসেম্বর বুধবার, রাওয়াল পিন্ডি, পাকিস্তান-
গোলাম আযম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে ৭০ মিনিট বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিবাহিনীকে শত্রুবাহিনী আখ্যায়িত করে গোলাম আজম বলেন, “এদেরকে ধ্বংস করার জন্য রাজাকার বাহিনীই যথেষ্ট।”
যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের মানবতাবিরধী অপরাধ সমূহঃ
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই যুদ্ধাপরাধীর গোলাম আযম এর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ আমলে নিয়ে ১১ জানুয়ারির মধ্যে এই নরঘাতক রাজাকার কে স্বশরীরে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়।
১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করা হলে , তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরন করার নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। বয়স আর স্বাস্থ্যর কথা পুনর্বিবেচনা সাপেক্ষে আদালত এই রাজাকার কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখার নির্দেশ দেয়।
মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয় ২০১২ সালের মে মাসের ১৩ তারিখ। যে মানবরাবিরধী অপরাধের অভিযোগে এই নাটের গুরু জামায়েত ইসলামীর আমীর শীর্ষ রাজাকার গোলাম আযম কে অভিযুক্ত করা হয়, সেগুলো হলঃ
১। মানবতাবিরধী অপরাধ সংগঠনের ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ৬ টি অভিযোগ। এর মধে অন্যতম- সামরিক আইন প্রশাশক টিক্কা খানের সাথে দুই দফায় সাক্ষাৎ করে “শান্তি কমিটি” গঠনের ষড়যন্ত্র করা এবং রাজাকার বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার পরামর্শ প্রদান।
২। মানবতাবিরধী অপরাধের ষড়যন্ত্র অনুযায়ী অপরাধ সংগঠনের পরিকল্পনার ৩ টি অভিযোগ। এক্ষেত্রে অন্যতম- টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে ১৪০ সদস্য নিয়ে “শান্তি কমিটি” গঠন।
৩। মানবতাবিরধী অপরাধ সংগঠনের উস্কানি দেয়ায় ২৮ টি অভিযোগ। এর মধ্যে অন্যতম- স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালিদের ‘ভারতীও অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যায়িত করে তাদের ধ্বংস করার আহ্বান জানায়, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে পাক বাহিনীর সহযোগী সংগঠনগুলোর সদস্যদের দেশপ্রেমিক আখ্যা দিয়ে সাধারণ জনগণের উপর হামলার আহ্বান জানায়।
৪। মানবতাবিরধী অপরাধে সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার ২৩ টি অভিযোগ। অন্যতম অভিযোগ- প্রাথমিক ভাবে গঠিত শান্তি কমিটির নাম পরিবর্তন করে ‘কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি’ রাখা। এবং সেখানে কার্যকরী সদস্য হিসেবে যোগ দেয়া। দেসি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী জনগণকে “দুষ্কৃতিকারী” বলা, এবং তাদের “পাকড়াও” চেষ্টা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া। নির্বাচনে বিজয়ীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় হয়নি বলে প্রচারণা চালানো।
৫। ব্যাক্তিগত ভাবে সরাসরি হত্যা ও নির্যাতনের ১ টি অভিযোগ। একাত্তরে মোহাম্মদপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর সিরু মিয়া ও তার ছেলে সহ ছয়জন ভারতে যাওয়ার সময় কসবা চেকপোস্ট এলাকার কাছে রাজাকারদের হাতে ধরা পরেন ২৭ অক্টোবর। তাদের স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে করেকদিন নির্যাতনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখবর পাবার পর সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সাথে যোগাযোগ করেন। গোলাম আযম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারে মিয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ দেয়া ছিল। চিঠি পাবার পর ইদের দিন রাতে সিরু মিয়া ও তার ছেলে সহ ৩৯ জঙ্কে পৈরতলা ব্রিজের কাছে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে ৩৮ জন মারা গেলেও একজন প্রানে বেঁচে যান।
৬৩ টি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এবং প্রত্যেকটি অভিযোগ প্রমানিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই যুদ্ধাপরাধের শিরোমণি গোলাম আযমকে বয়স বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদণ্ডে (৯০ বছর) দণ্ডিত করে।
গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, জোর পূর্বক ধরে ধর্মান্তরিত করা এসকল জঘন্য মানবতাবিরধী অপরাধ করেছে যা ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে। স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি যারা আছি আমরা আমরা সারাজিবন এই নরঘাতককে ঘৃণা ভরে স্মরণ করে জানো। ইতিহাসের এক কলঙ্কিত নাম আর বাংলার অভিধানে মীরজাফরের মতো একটি নাম হল রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযম।
বয়স অনুযায়ী যে শাস্তি এই নরঘাতক কে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দিলেন সেটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। এই নরঘাতক যখন অপরাধগুলো করেছিলো সে বয়স দেখেনি, সে দেখেনি শিশু, সে দেখেনি বৃদ্ধ। সে দেখেনি মেয়ে মানুষ। সকলকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। আমরা চাইব সরকার পক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্যই আপিল করে এই শীর্ষ রাজাকারের ফাঁসির রায় নিশ্চিত করবেন।
নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলার ইতিহাসের আর এক মীরজাফর রাজাকার গোলাম আযম এর সকল কৃত কর্মের কথা তুলে ধরলাম। আশাকরি সকলে আমার এই লেখাটি পড়ে গোলাম আযমের কুকর্মের সকল ইতিহাস জেনে এই নরঘাতকের ফাঁসির দাবীর আন্দোলনকে আরও তরান্বিত করবেন। তাহলেই আমার এই লেখাটির সকল কষ্ট সার্থক হবে।
সূত্রঃ
- গোলাম আযম উইকিপিডিয়া
- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
- মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্র
- দালাল আইন
- মুক্তিযুদ্ধ ই- আর্কাইভ
- দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা