কুখ্যাত রাজাকার আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও তার অপরাধ সমূহ

বাংলাদেশের ইতিহাসের কুখ্যাত ঘৃণ্য রাজাকার ছিল আলবদর বাহিনী প্রধান আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। নরঘাতক এই রাজাকার এর জন্ম হয় ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলায়। মুজাহিদের পিতা  মওলানা  মোহাম্মদ আলী শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। উল্লেখ্য এই শান্তি কমিটিও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত রাজাকার বাহিনীদের মধ্যে অন্যতম একটি দল ছিল। ফরিদপুর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য রাজাকার মুজাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় ১৯৭০ সালে।

মুজাহিদ ফরিদপুরের ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হয় ১৯৬৮ সালে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর ঢাকার ছাত্র সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হয় ১৯৭০ সালে। পদোন্নতি হয় ১৯৭০ এর আগস্ট- সেপ্টেম্বর। সরাসরি  তৎকালীন  নিখিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক শাখা, পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্র সংঘের সেক্রেটারি পদে বহাল হয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে সরাসরি নির্বাচিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি। এর পর আলবদর বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করে। পরে কুখ্যাত নরঘাতক রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীর কাছ থেকে সুপ্রিম কমান্ডর এর দায়িত্ব নিয়ে আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করে। এই রাজাকার আর আলবদর বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল স্বাধীনতাকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে তুলে দেয়া এবং এদেরকে ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন করা, নির্বিচারে হত্যা করা, নারীদের ধর্ষণ করা, বসত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে সমূলে নিধন করা।

এক নজরে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এর গ্রেফতার থেকে ফাঁসির রায় কার্যকর পর্যন্ত দিন/তারিখঃ

  • মানবতা বিরোধী অপরাধে গ্রেফতারঃ ২৯ জুন ২০১০
  • দাখিল কৃত অভিজগঃ ১৬ জানুয়ারি ২০১২
  • অভিযোগ গঠনঃ  ২১ জুন ২০১২ , আসামীর বিরুদ্ধে ৭ টি অভিযোগ গঠন করা হয়।
  • ফাঁসির রায়ঃ ১৭ জুলাই, ২০১৩
  • রায়ের বিরুদ্ধে আসামী পক্ষের আপিলঃ ১১ আগস্ট ২০১৩
  • আপিল বিভাগের রায়ঃ ১৬ জুন ২০১৫, ফাঁসি বহাল।
  • আসামী পক্ষের পুনর্বিবেচনার আবেদনঃ ১৪ অক্টোবর ২০১৫
  • পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজঃ ১৮ নভেম্বর ২০১৫
  •  অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ ২২ নভেম্বর ২০১৫

যুদ্ধাপরাধী কুখ্যাত রাজাকার আলবদর নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগঃ

 অভিযোগ-১
একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ। মুজাহিদের পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭/৮ জন যুবক তাকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। পরে তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই অভিযোগে আপিল বিভাগ তাকে খালাস প্রদান করেন।

অভিযোগ-২
একাত্তরের মে মাসে মুজাহিদের নেতৃত্বে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানায় বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের প্রায় তিন শ’ থেকে সাড়ে তিন শ’ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করে। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল খালাস প্রদান করেন।

অভিযোগ-৩
একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গেয়ালচামট (রথখোলার) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। বেলা অনুমান ১১টার দিকে ফরিদপুর পুরোনো সার্কিট হাউসে আসামি আলী আহসান মুজাহিদের সামনে পাকিস্তানি সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে হাজির করা হয় বাবু নাথকে। তখন মুজাহিদ ওই মেজরের সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার একটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আব্দুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরে রাতে রণজিৎ নাথ বাবু তার আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ওই ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। আপিল বিভাগও এই শাস্তি বহাল রাখেন।

অভিযোগ-৪
একাত্তরের ২৬ জুলাই সকাল বেলায় ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখি, পিতা- মৃত মো. জয়নাল আবেদীন, গ্রাম-পূর্ব গোয়ালচামট খোদাবক্সপুর, থানা- কোতোয়ালি, জেলা- ফরিদপুরকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করা হয়। এরপর পাখিকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক করা হয়। আটক বন্দিদের মধ্যে আবু ইউসুফ পাখিকে দেখে মুজাহিদ সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি মেজরকে কিছু একটা বলার পরই তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেখানে ১ মাস ৩ দিন আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্যাতনের ফলে আবু ইউসুফ পাখির বুকের ও পিঠের হাড় ভেঙ্গে যায়। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে খালাস প্রদান করেন।

অভিযোগ-৫
১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। আসামি মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে ছাড়া অন্যান্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। আপিল বিভাগও তার এই সাজা বহাল রেখেছেন।

অভিযোগ-৬
একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল  ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও ওই স্থানে ক্যাম্প করে গ্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালায়। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হবার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত উর্ধতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আসামী আলী আহসান মোহামদ মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানসহ সারা বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন সহ যাবতীয় মানবতবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিল বিভাগও তা বহাল রাখেন।

অভিযোগ-৭

একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করে। শান্তি কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বকচর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রি, সত্য রঞ্জন দাশ, নিরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করা হয়। উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকা দিয়ে তার স্বামীর মুক্তি চান। রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝুমা রানীকে ধর্ষণ করে। পরে আটক হিন্দু নাগরিকদের হত্যা করে। তাদের বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অনিল সাহাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলেও আপিল বিভাগ তা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।

ইতিহাস সাক্ষী দেয়, এই নরঘাতক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ফকিরাপুল,নয়াপল্টনএলাকার বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান করত। সেখ ভিলা ,৩/৫ নয়াপল্টন তার মধ্যে একটি। প্রধান আড্ডা ছিল ফকিরাপুলের গরম পানির গলি ১৮১ নং এর ফিরোজ মিয়ার বাড়ি। এসকল বাড়িতে সশস্ত্র ট্রেনিং সহ, সভা, রাজাকার রিক্রুটমেন্ট, অপারেশন,  মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে শারিকির নির্যাতন এই কাজ গুলো পরিচালনা করত মুজাহিদ। ফরিকাপুল আরামবাগের শত শত নিরস্ত্র নিরাপরাধ বাঙ্গালি হত্যা করেছে। মুজাহিদ এর নির্যাতন তৎপরতা ছিল গোটা ঢাকায়।

স্বাধীনতার পর কয়েক বছর এই নরঘাতক তার অন্য সহযোগীদের সঙ্গে পালিয়ে বেড়ালেও ১৯৭৭ সাল থেকে আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হন। আবির্ভূত হয়েই পুরনো অভ্যাস ও আদর্শ অনুযায়ী হত্যার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেই থেকে অপ্রতিরোধ্য এই নরঘাতক ক্ষমতার দাপটে পদলিত করেছেন মানবতা। যাদের রক্তদান ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশ সেই রক্ত ও আত্মত্যাগের সঙ্গে আজন্ম বিশ্বাসঘাতক এই মুজাহিদ চারদলীয় সরকারের ৫ বছর সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা দেশে। অপরাধ কোনদিন ঢাকা থাকে না। বিচার হবেই। মুজাহিদ এর মতো কুখ্যাত রাজাকার সকলের বিচার এই বাংলার মাটিতে হচ্ছে, এবং আগামীতেও হবে। নরঘাতক মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির পথে আর এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। জয় বাংলা।

সুত্রঃ

  1. আলী আহসান মুজাহিদ উইকিপিডিয়া
  2. মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্র
  3. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
  4. ১৯৭২ দালাল আইন

You may also like...

Read previous post:
সাকা নামের এক পাশবিক অধ্যায়ের সমাপ্তি

যাক, শেষ পর্যন্ত সাকা নামের এই পাশবিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। সকল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকলের প্রতি রইলো অভিনন্দন। একাত্তরে...

Close