শেরপুর সদর উপজেলার মুদীপাড়া গ্রামের মরহুম আলহাজ ইনসান আলী সরকার, এবং সালেহা খাতুন এর সন্তান ঘাতক রাজাকার মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই জন্মগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের জন্য রাজধানীর মিরপুর-১১ এর পল্লবীর সাংবাদিক আবাসিক এলাকার এফ ব্লকের ৪নং রোডের ১০৫নং বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয়।
এই রাজাকার মাধ্যমিক পাশ করে ১৯৬৭ সালে এর পর উচ্ছ মাধ্যমিক এর জন্য ভর্তি হয় জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে। এই কুখ্যাত রাজাকার রাজনীতিতে যোগ দেয় ১৯৬৭ সালে তৎকালীন জামায়েতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। শেরপুর জিকেএম ইনস্টিটিউশনের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ছিল এই রাজাকার।
কামারুজ্জামান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হয়ে যায় যখন আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজে পড়ত। সহকারী সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচন করে কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। ধীরে ধীরে এই রাজাকার ১৯৭০ সালের শেষের দিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে এই দায়িত্ব পায়। তৎকালীন সময়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের নিখিল পাকিস্তানের সভাপতি ছিল আর এক কুখ্যাত রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ছিল রাজাকার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। সাধারণ সম্পাদক থেকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হবার পরেই আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ কামারুজ্জামানকে ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক অফিসের দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়।
আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এই কুখ্যাত কামারুজ্জামানঃ
যেহেতু কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহে তৎকালীন জামায়েত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন সংঘের সভাপতি ছিল তারি সুবাদে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিল এর ২২ তারিকে জামালপুরের মহকুমায় আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাইকৃত অনুগত পেয়ারের বান্দাদের নিয়ে সর্বপ্রথম জামায়েতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনী গড়ে তোলে। কামারুজ্জামান ছিল এই বাহিনীর অন্যতম প্রধান সংগঠকদের একজন। স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ড ছাড়াও লেখক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, শিল্পী, আইনজীবী, কবি, সাহিত্যিক সহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কিলিং স্কোয়াড তৈরি করে এই ঘাতক। আলবদর প্রতিষ্ঠার এক মাশের ভিতরে বৃহত্তর ময়মনসিংহর ছাত্র সংঘের সকল কুখ্যাত ক্যাডার ও সন্ত্রাসীদের আলবদর বাহিনীর সদস্য করে নেয়।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর, ময়মনসিংহ সদর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল জেলার ৪৭ জন ছাত্র সংঘের কর্মীদেরকে আলবদর বাহিনী হিসেবে ১৬ই মে পরীক্ষামূলক ভাবে ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের তত্ত্বাবধায়নে সশস্র সামরিক ট্রেনিং দেয়া শুরু করে। ৭ থেকে ১২ দিনের উপরে এই ট্রেনিং চলে। সকল ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্র ব্যাবহার থেকে শুরু করে অস্র খুলে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নেয়া, বিস্ফোরক, মাইন অকেজ করা, ওয়্যারলেস কি করে ব্যাবহার করতে হয় সকল কিছুর ট্রেনিং দেয়া হতো। বারা বরগান,থ্রী নট থ্রী, লাইট মর্টার গান, এন্ট্রি এয়ার ক্রাফট গান, হ্যান্ড গ্রেনেড, মাইন্স এবং রিভলবার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনিদের কাছ থেকে এনে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের সরবরাহ করত এই কামারুজ্জামান।
এই আলবদর বাহিনীর কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ সদরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং নিরস্ত্র সাধারণ বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত করতে থাকে দলটি। শহর-গ্রাম-গঞ্জে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধকর্ম অব্যাহত রাখে যা সেখানকার হিন্দু গোষ্ঠীসহ অন্যান্যদের দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয় এই আলবদর বাহিনিকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অত্যাচার, তাদেরকে খুঁজে বের করা, হিন্দুদের জোর করে মুসলিম বানানো, বিভিন্ন সভা সেমিনার ও প্রচার পত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী প্রচারণা, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা এবং প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সশস্র মোকাবেলার কাজে নেতৃত্ব দেয় কামারুজ্জামান।
আলবদর বাহিনী তৎকালীন সময়ে সারা পূর্ব পাকিস্তানের ছড়িয়ে পরে। কামারুজ্জামানকে নির্বাচিত করে ডেপুটি চিফ অফ কমান্ডো করা হয়। ঠাণ্ডা মাথায়, কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের শেষ ৫ টা মাস এই আলবদর বাহিনীর নৃশংসতার নিল নকশা প্রণয়ন করে কামারুজ্জামান ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিলো। উল্লেখযোগ্য ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড যা আলবদরকে নৃশংস ঘাতকে পরিনত করে।
কুখ্যাত এই রাজাকার কামারুজ্জামান এর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আনিত অভিযোগঃ
প্রথম অভিযোগ :
৭১’র ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সারারাত নির্যাতন করা হয়। পরদিন আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ :
কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে মাথা ন্যাড়া করে উলঙ্গ অবস্থায় গায়ে ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শেরপুর শহর ঘোরায়।
তৃতীয় অভিযোগ :
৭১’র ২৫ জুলাই ভোর বেলায় কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। এ সময় ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের মহিলারা। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর গ্রাম ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত।
চতুর্থ অভিযোগ :
৭১’র ২৩ আগস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়। মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম এরপর কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে তার ভাতিজাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই রাতে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগি নদীর ওপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হলেও হাতের আঙ্গুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যায় আবুল কাশেম।
পঞ্চম অভিযোগ :
মুক্তিযুদ্ধকালে রমজান মাসের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুরের চকবাজার থেকে লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমানকে অপহরণ করে বাঁথিয়া ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর থানায় চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ওই দু’জনসহ ১৩ জনকে ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে লিয়াকত, মুজিবুরসহ ৮ জনকে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের কাছে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ষষ্ঠ অভিযোগ :
৭১’র নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহের জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। টুনুকে সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।
সপ্তম ও শেষ অভিযোগ:
মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান দিন দুপুরে কামারুজ্জামান আল-বদর সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরদিন সকালে আলবদররা ওই দু’জনসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করান। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে লাফ দেন। আল-বদররা গুলি করলে তার পায়ে লাগে। তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু অন্য ছয়জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
কামারুজ্জামান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক ভয়াবহ আতঙ্ক। ওই সময়ে নিরাপরাধ মানুষদের ধরে ধরে নির্বিচারে হত্যা করেছিলো। নারীদের ধরে ধরে করেছিলো ধর্ষণ। আলবদর বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন করে পাক সেনাদের নিয়ে নৃশংসতার নীল নকশা এঁকেছিল এই কুখ্যাত রাজাকার কামারুজ্জামান। যারা প্রশ্ন তোলেন কেন মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধর এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, আপনাদের জন্য বলি ইতিহাস জানুন, পড়ুন , কুখ্যাত রাজাকার এদের অপরাধ গুলো কি কি ছিল বিস্তারিত ভাবে জানুন। এদের কে যদি ক্ষমা করা হয় তাহলে বৃথা হয়ে যাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের এই মহান আত্মত্যাগ। দেশ হবে কলঙ্কিত। একটি বীরের জাতি ধ্বংস হয়ে বিলীন হয়ে যাবে।
সূত্রঃ
- মুক্তিযুদ্ধের দলিল্পত্র
- কামারুজ্জামান উইকিপিডিয়া
- ঘাতক দালাল আইন
- Somewherein blog
- ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ