ফরিদপুরের বর্তমান ত্রাস এবং হিন্দুদের জমি দখলকারী বলতে পুরা ফরিদপুরে মানুষ যাকে এক নামে চেনে তার নাম ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার সন্ত্রাসী দলের প্রধান তার ভাই বাবর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের খন্দকার নুরু মিয়া ছিলেন জেলা শান্তি কমিটির সদস্য। তাঁর পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সেই নুরু মিয়ার ছেলে খন্দকার মোশাররফ হোসেন এখন ফরিদপুর আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা। দলীয় রাজনীতি না করেও খন্দকার মোশাররফ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পেয়ে সবাইকে চমকে দেন। এরপর ২০০১ সালেও মনোনয়ন পান তিনি। কিন্তু দুবারই পরাজিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে তিনি ঠাঁই পান মন্ত্রিপরিষদে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের মতে, খন্দকার মোশাররফের প্রধান শক্তি হলো, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন নিজেও প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক আমাকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে দিয়েছে। তবে রাজনীতি বেয়াই-বেয়াইনের বিষয় নয়। জনগণের ভালোবাসা নিয়ে টিকে আছি।’ অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রী হওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধী প্রয়াত বাবার নাম এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করা তাঁর প্রধান কাজে পরিণত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলেও তাঁর ওপর নেমে আসে খড়্গ। তাঁর দাপটে আওয়ামী লীগের পুরোনো নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, প্রভাবশালী এই মন্ত্রী এলাকায় প্রকৃত নেতা-কর্মীদের পাশ কাটিয়ে ‘নতুন আওয়ামী লীগ’ গড়ে তুলেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। নতুন আওয়ামী লীগের শীর্ষে আছেন মন্ত্রীর ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর। তিনি অবশ্য আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। প্রাথমিক সদস্যপদও নেই তাঁর। জ্যেষ্ঠ নেতাদের সরিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা মোকাররম হোসেন ওরফে বাবু হচ্ছেন মন্ত্রীর সবচেয়ে কাছের লোক। ফরিদপুর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিপুল ঘোষ বলেন, এখানে যা চলছে তাকে তামাশা ও স্বেচ্ছাচারিতা বলা যায়। এখানে কোনো রাজনীতি নেই। আরেক প্রবীণ নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল হক ওরফে ভোলা মাস্টার বললেন, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী পরিবর্তন না হলে দলের ভরাডুবি হবে। মন্ত্রীর অপকর্ম নিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সমস্যা সমাধানের আশ্বাস পেয়েছেন। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই।
মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বললেন ভিন্ন কথা। তাঁর দাবি, স্থানীয় কয়েকজন নেতার কারণে ১৯৯৬ ও ২০০১-এর নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছেন। ২০০৮ সালে তাই নির্বাচনের সব দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করেন। এঁদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা একসময় হয়েছে। কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। এঁরা সংখ্যায় খুবই কম।
নির্বাচনের পর খন্দকার মোশাররফ প্রথমেই তাঁর বাবার নামে শহরের বিভিন্ন সড়ক ও স্থাপনার নামকরণের উদ্যোগ নেন। এ কাজে দলীয় নেতাদের বিরোধিতার মুখে পড়েন তিনি। মূলত এ থেকেই দলে প্রকাশ্য বিরোধের শুরু। এর পর থেকেই জ্যেষ্ঠ নেতাদের পাশ কাটিয়ে আজ্ঞাবহদের কাছে টানতে শুরু করেন তিনি। নুরু মিয়াকে রাজাকার বলায় এবং মন্ত্রীর ভাইয়ের বাসাকে ‘হাওয়া ভবনের’ সঙ্গে তুলনা করায় কোপ খেতে হয় জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি নুর মোহাম্মদকে। একই কারণে কুপিয়ে আহত করা হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শওকত হোসেন জাহিদকে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়ে হামলায় আহত হন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মুনিরুজ্জামান। এসব ঘটনায় কারও শাস্তি হয়নি। প্রথম দুটি ঘটনার জন্য মোকাররম হোসেনকে আসামি করে মামলা হয়। কিন্তু পুলিশ দ্রুততার সঙ্গে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে আসামিদের নিরপরাধ বলে জানিয়ে দেয়; বরং দলীয় প্রতিপক্ষের অনেক নেতার বিরুদ্ধে দেওয়া হয় মামলা। সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হাসানের বাসায় হামলার পর আওয়ামী লীগ চুপ হয়ে যায়। হাসিবুল হাসানের মৃত্যুর পর পুরো আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মন্ত্রী ও তাঁর মনোনীত লোকদের হাতে। মন্ত্রী তাঁর বাবা সম্পর্কে বলেন, ফরিদপুরে তিনি হয়তো একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু এটা ছোট কোনো ব্যাপার নয়। তাঁর বাবা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। বাবা-দাদাদের কারণে তাঁর বিজয় সহজ হয়েছে। তাঁর বাবা যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না। সাধারণ মানুষের জন্য অনেক করেছেন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশাসন ও পুলিশের সরাসরি সহায়তার কারণে গুটিকয়েক নেতা ও ক্যাডার টেন্ডার, জমি দখল, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন। দলীয় কর্মকাণ্ড হয়ে পড়ে গৌণ। তবে ফরিদপুর সদর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটি ভেঙে দিয়ে নিজেদের লোক বসিয়ে নতুন কমিটি গঠনের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে পুরোনো কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অনুপস্থিত রাখা হচ্ছে। নিজের লোক না হওয়ায় কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ বোসকে পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্র থেকে তা অনুমোদন করা হয়নি। একইভাবে পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি করা হয়েছে। এতে সভাপতি করা হয়েছে মন্ত্রীর একসময়ের সহপাঠী সত্তোরোর্ধ্ব সুলতানা বেগমকে। যদিও তিনি কখনো আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। তবে তাঁর স্বামী আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে খাইরুদ্দিন মিরাজকে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংবাদ করায় প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধি পান্না বালাকে মারধর করেন এই মিরাজ।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর হামলা চালিয়ে দলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র আসিবুর রহমান ও ফাহাদ বিন ওয়াজেদ। এরাই এখন ছাত্রলীগের মূল কান্ডারি। এর মধ্যে আসিবুর রহমান মন্ত্রীর ভাতিজা। এই দুজনের বাবা-মা স্থানীয় জামায়াতের নেতা। আর নিজ দল থেকে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে পৌরসভা নির্বাচনে জিতিয়ে আনা হয় একসময়ের বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতা শেখ মাহতাব আলীকে। তিনি এখন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। জেলা পরিষদের প্রশাসক করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতি জয়নুল আবেদিনকে। তিনি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। সেখান থেকে এনে তাঁকে দলের সভাপতি করা হয়। তিনি সরাসরি কোনো পক্ষে নেই।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা জানান, তাঁরা মন্ত্রীকে জেলায় অবাঞ্ছিত ঘোষণার জন্য গত ১৯ মে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। কিন্তু ঢাকা থেকে টেলিফোন করে এটা করতে নিষেধ করা হয়। ওই দিন জেলা নেতাদের ডেকে নিয়ে গণভবনে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে সব শুনে প্রধানমন্ত্রী ১৫ দিনের মধ্যে সবকিছু সমাধানের আশ্বাস দেন। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে বিষয়টি মীমাংসা করার নির্দেশ দেন। সৈয়দ আশরাফ ২৭ মে তাঁর বাসভবনে মন্ত্রী ও অপর পক্ষের নেতাদের আসতে বলেন। প্রথমে মন্ত্রী রাজি হন। পরে সময় ২৯ মে করার কথা বলেন। কিন্তু ওই দিনও তিনি বৈঠকে আসেননি। তাঁর মতো একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর পক্ষে সৈয়দ আশরাফের বাসায় গিয়ে সালিস বৈঠকে থাকা সম্মানজনক বলে তিনি জানিয়ে দেন। ফরিদপুরের সাধারণ মানুষও মন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে বলেছেন। তাঁদের বক্তব্য, মন্ত্রী নিজে কিছু করেন না। কিন্তু তাঁর ভাই ও অন্যরা স্থানীয় বাসিন্দাদের নানাভাবে বিরক্ত করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রীর কাছে বললে তিনি তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পরিবারের কেউ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। নিজের ভাই ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগের কথা তিনি শুনেছেন। কিন্তু প্রমাণ পাননি। তিনি বলেন, প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।