হাসিনার পেট্রোল বোমার রাজনীতি- শেষ পর্ব

হাসিনা বলছেন তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনোরোদ্ধারে নেমেছেন। জাতীয় নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচনে লুট করেছেন, বি এন পিকে নির্বাচনে আসতে দেনই নি। যদিও বেগম জিয়া সংলাপের জন্য দাওয়াত দিয়েছিলেন তাঁর বাসায়। সুযোগ ছিলো সরাসরি সংলাপের। এমনকি বেগম জিয়ার তরফ থেকে সুস্পস্ট প্রস্তাব ছিলো নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে সে বিষয়েও। শেখ হাসিনার পছন্দমত উপদেষ্টা নির্বাচনের ব্ল্যাংক চেক দেয়া ছিলো সে প্রস্তাবে। তিনি সেই দাওয়াত শুধু প্রত্যাখ্যান-ই করেন নি বরং বেগম জিয়ার সাথে যে অভব্য আচরণ করেছেন সেটি বোধকরি সারা বাংলাদেশের মানুষই শুনেছেন এবং জেনেছেন। যেদিন দাওয়াত দেয়া হয়েছিলো সেই দিনটি ছিলো রবিবার। হাসিনাকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি চুড়ান্ত ঐক্যমত্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে বলেছিলেন যে হরতাল চালিয়ে যেতে চাইলে চালিয়ে যান তাতে তার দলের কিছুই আসে যায়না। আর এমন এক অবস্থার প্রেক্ষিতে বি এন পি’র জন্য হরতাল ছাড়া আর কোনো পথই খোলা ছিলো না। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে অপহরনের পর মুক্তিপণ চাইবার ও সেটি না মানলে খুন করে ফেলবার যে পদ্ধতিটুকু রয়েছে সেটির চিহ্ন জ্বলজ্বলে ভাবে বিদ্যমান।

তাঁর এবং তাঁর সাথে থাকা বাকি জোটভুক্ত দলের মনে হয়েছে এই ধরনের ব্যাবস্থায় বি এন পির নাম দিয়ে ও পেট্রোল বোমার গল্প সাজিয়ে ক্ষমতা ভালো করেই টিকিয়ে রাখা যাবে সুতরাং দেশের নানান পরিবহনে তাঁর কর্মীদের লেলিয়ে দিয়ে পেট্রোল বোমা মেরে জনতার প্রধানমন্ত্রী  সেই জনতাকেই আগুনে পুড়িয়ে মারাটা হাসিনার জন্য হয়ে উঠেছে অত্যধিক রিজেনেবল। হাসিনা ভুয়া নির্বাচন করবার ফলে পেয়েছেন ক্ষমতা। আর সেক্ষমতা বলে তিনি আরো পুড়িয়েছেন বাস, ট্রাক আর সর্বশেষ মানুষ। সুতরাং নুরুজ্জামানরা ঘুরে বেড়াবে বাসে, ট্রাকে, রিকশায়? অবশ্যই এ হতে পারেনা। তিনি হারিয়েছেন ক্ষমতার লাল ভেলভেটের মসনদ, সচিবালয়, ক্যাবিনেট, হাজার হাজার কোটি টাকার কাঁচা বাণিজ্য, হাওয়া ভবন কিংবা অনাগত আদম ভবন। সুতরাং বোমা তো খেতেই হবে। অনাগত আদম ভবন হারাবার ক্ষোভে আগুনে পুড়বে জীবন্ত আদম, এটাই এখন স্বাভাবিক নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্ত্রই তো হাসিনার ক্ষমতার উৎস আর সে অস্ত্রবাজ পুলিশ আর সেনাবাহিনী যখনহ পক্ষে রয়েছেন সুতরাং বোমা মেরে কয়লা বানাতে হবে এই জনতাকেই।

এটা এখন স্পস্ট যে হাসিনা রাজনৈতিক দলের খোলশ গায়ে লাগিয়ে ও গনতন্ত্রের বুলি কপচিয়ে যে খুনে আন্দোলনে নেমেছেন সেখানে তিনি ছুরি ধরেছেন সাধারণ জনতার চিবুকে। হিসেবটা খানিকটা সরল ও বর্বর। সাংবিধানিক ভাবে যতই আইন দেখাক বা বৈধতা দেখাক কিন্তু জনতার আদালতে অবৈধ একটা সরকারকে টিকিয়ে রাখবার জন্য জিম্মি হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে পুরো বাংলাদেশের সাধারণ জনতাকে। ভেবেই নেয়া হয়েছে যে, দেশ যেহেতু  আজকাল খালেদার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে জনপ্রিয়তার দিক থেকে সুতরাং দেশের জনতা্কে বি এন পি’র নামে বোমা মেরে একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া দরকার। আর জনতার দায় যেহেতু সরকারের সুতরাং নিরাপত্তাহীনতার যে কোনো কারনেই জনতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে সরকারকেই। সরল অংকের প্রথাগত নিয়মে এই জনতার নিরাপত্তাকে নিঃশেষ করে দিতে পারলেই সমাজে তৈরী হবে অষন্তোষ এবং একটা পর্যায়ে সাধারন জনতা ফুঁসে উঠবে এবং চাপ দিবে সেই সরকারকেই, গাল দিবে সেই সরকারকেই, আস্থা হারাবে এই সরকারের কাছ থেকেই। আর সে সময় বি এন পি নেতা কর্মীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে, গ্রেফতার করে এই সুরকার নাটকীয়তা তৈরী করে দেখিয়ে দেবে যে তারাই আসলে এই বোমা মারা বন্ধ করেছে, তারাই আসলে বি এন পি’কে স্তব্বধ করেছে। এতে করে সাধারণহ জনতা হয়ত সাম্যিক ভাবে বিভ্রান্ত হবে কিন্তু সত্য থেকে ক্যদিন এইভাবে দূরে রাখা যাবে?

প্রথমত আমার জানা দরকার যে, আমাদের এই বাংলাদেশের জন্মের শুরুতে যেই বাকশালী সুরকার এই দেশের সাথে যে বেঈমানী করেছে কিংবা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব তৈরী হোক এমনটা চায়নি এবং যেই দল তাদের এই না চাওয়া থেকে খুনী পাকিস্তানী ভুট্টোর সাথে হাত মিলিয়ে নানাবিধ চুক্তি করেছে আবার অন্যদিকে ভারতের সাথে আতাঁত করে দেশটা বিক্রি করে দিয়েছে তেমন একতা দলের সাথে খালেদা জিয়া জিয়া যে সংলাপের জন্য বসেছেন এইটাই আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার মনে হ, হাসিনার মত একটা খুনীর সাথে এক টেবিলে বস্তে চাওয়াটা অন্যায়ের।

দ্বিতীয়ত আমার জানা দরকার, যদি তথাকথিত সংবিধান এর পুঁথিগত মানে দাঁড়ায় গণতন্ত্র আর সেটা যদি হয় হাসিনার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিনাশের মাধ্যমে তবে সাধারন জনতা হিসেবে আমাদেরও স্পস্ট জানবার অধিকার রয়েছে ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার চলছে সেটির বিষয়ে। শেখ হাসিনা গত ছয় বছরে তাঁর ভাষনে একাধিকবার এইসব রাজবন্দীদের তদন্ত ও বিচারের আগেই দোষী বলে উল্লেখ করে বিভিন্ন সমাবেশে তাঁদেরফাঁসী দেবেন বলে বলেছেন। আইন আর আদালতের সমস্ত নর্মস, সঙ্গাকে উপেক্ষা করে তিনি সেসব সভা আর সমাবেশেই সরাসরি এইসব কথা বলেছিলেন। অতএব এটা আমার অবশ্যই জানা দরকার যে আমি কেন হাসিনাকে সরকারের প্রধান হিসেবে দেখতে চাইব যিনি এই ঘাতকদের মুখপাত্র হিসেবে আর আইন আদালতের তোয়াক্কা না করে তাদের মুক্তি দিতে চান?

যে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে হাসিনা চেঁচিয়ে যাচ্ছেন বা আছে বলে দাবী করছেন সেই হাসিনাই আবার রাতের আঁধারে পুড়িয়ে মারছেন মানুষ। এই ইতিহাস কি আওয়ামীলীগের নতুন? আওয়ামী মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ২০০৩ সালে শেরাটনের সামনে গান পাউডার দিয়ে ১২ জন মানুষ্কে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলেন। সে ইতিহাস কি আমরা ভুলে গেছি? তিন তিনবারের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যেখানে এইভাবে হামলা ও নাশকতার নির্দেশ দেন সেখানে এই বাংলাদেশ নিয়ে আমি কোন স্বপ্ন দেখব? গত ৬ টি বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলে থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়া আর তার ১৯ দলের নেতাকর্মীরা বিরোধী রাজনৈতিক দল, এই কারনে যে অত্যাচারের মুখে পড়েছেন সেটি আসলে বর্ণনার অযোগ্য। ন্তায দিকে হাসিনা দেশের মানুষের জন্য কি করেছেন? তারা কি একটা কার্যকর শিক্ষানীতির প্রস্তাব দিতে পেরেছেন? তারা কি পেরেছেন আমাদের রাষ্ট্রনীতি উন্নয়নকল্পে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে? তারা কি পেরেছেন যে ক্ষমতায় গেলে তাদের কৃষিনীতি ও এই বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা কি হবে সেটির কোনো প্রস্তাব দিতে? তারা কি পেরেছেনে আমাদের অর্থনীতি, সমাজনীতি, পরারাষ্ট্র নীতি, অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়নের প্রস্তাব দিতে? তারা কি সরকারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনো? কখনো কি আদৌ তারা বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করেছেন?

এসব সব প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, না, তারা এর কিছুই করেন নি। করার ভেতর তারা কেবল পেরেছেন সেভেন আপ কিংবা কাঁচের বোতলের ভেতর খোলা বাজার থেকে পেট্রোল কিনে সেটি সাধারন আমজনতার দিকে তাদের দলীয় পান্ডাদের দিয়ে ছুঁড়ে মারতে আর সেটি করে বি এন পির নাম দিয়ে তাদের নিরীহ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করতে। ভ্যাম্পায়ার যেমন অনেকদিন রক্তের সাধ না পেলে উন্মাদ হয়ে ওঠে, হাসিনা তেমন উন্মাদ হয়ে উঠেছেন ক্ষমতার জন্য।

লেখার শেষ প্রান্তে এসে আমি আবারও আমাদের এই মৃত্যু উপত্যাকার  নুরুজ্জামানদের কথা বলে শেষ করি। হাসিনার গণতন্ত্র যাত্রার পেট্রোল বোমাতে যে নুরুজ্জামানদের স্বপ্ন, জীবন, পরিবার এভাবে সিম্পলী কাঠ কয়লার মত অঙ্গার হয়ে গেছে সেই খুনের পরে হাসিনা তাঁর স্বপ্নের গণতন্ত্রকে তথা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারবেন কিনা আমাদের জানা নেই। এই সব সম্ভবের বাংলাদেশে হয়ত সেটি পারবেন।

আমি কেবল ভাবি হতভাগ্য নুরুজ্জামানদের কথা। হয়ত হাসিনার সভাসদেরা একদিন নুরুজ্জামানদের নিয়া শোকসভা করবেন। গণতন্ত্র রক্ষা করবার জন্য হয়ত তাদের বানিয়ে দেয়া হবে গনতন্ত্র রক্ষার অগ্রদূত কিংবা প্রতিমূর্তি হিসেবে। হয়ত একদিন নুরুজ্জামানদের পরিবারের বাকি সদস্যদেরও বাধ্যতামূলক ভাবে এইসব সভা কিংবা সিম্পোজিয়ামে হাজির থাকতে হবে। হয়ত একদিন মাথা নীচু করে তাঁরাও বসে থাকবেন সেসব সভাতে ঠিক আজ যেমন নূর হোসেনকে গণতন্ত্রের আইকন বানিয়ে এরশাদও ফুল দিতে জিরো পয়েন্টে যান আর তাদের পরিবারকেও বসে থাকতে হয় বিভিন্ন সভা কিংবা সমাবেশে।

আজকে আমরা যারা গণতান্ত্রিক পেট্রোলবোমা ফাঁকি দিয়ে কোনোভাবে বেঁচে বর্তে আছি এই মৃত্যু উপত্যাকায় মূলত বলা যেতে পারে এই জনপদের অবশিষ্ট নুরুজ্জামান আমরা। মৃত নুরুজ্জামানদের কবর একদিন যেমন গণতন্ত্রের মাজার হিসেবে ব্যবহার হবার অপেক্ষা তাঁদের খুন হবার ঠিক পর থেকেই শুরু হয়েছে ঠিক তেমনি আমাদের মত বেঁচে থাকা নুরুজ্জামানদের পরবর্তী কবর হয়ে উঠবার অপেক্ষারও সূচনা হয়েছে।

ক্ষমতালোভী ভ্যাম্পায়ারদের এই মৃত্যু উপত্যাকায় একজন নুরুজ্জামান পরিচয় হিসেবে আমরা এইভাবে ক্ষমতার উৎস হয়ে বেঁচে ও মরে থাকি। আমাদের নিয়তি এইভাবেই লেখা হয়ে আছে।

You may also like...

Read previous post:
হাসিনার পেট্রোল বোমার রাজনীতি- পর্ব ১

প্রথমেই যে বর্ণনা দেব সেটির সময়কাল ফেব্রুয়ারী ১, ২০১৫। বর্ণনার মূল চরিত্র নুরুজ্জামান কবে কোথায় জন্মেছেন সেটা আমাদের জানা নেই।...

Close