বিশ্বে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আদর্শ বা রাজনৈতিক মতবাদ প্রাধান্য লাভ করে। এসব মতবাদ ধারণ করা তখন অনেকটা ফ্যাশনে পরিণত হয়। এক সময় দেশে দেশে মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হওয়া ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল। তখন এমন অনেক রাজনৈতিক দল নিজেদের সমাজতন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরত, যাদের দলীয় চরিত্রের সাথে সমাজতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
চরিত্রগতভাবে ছিল পুরো বুর্জোয়া, কিন্তু নাম হতো অথবা নীতির কথা বলত সমাজতন্ত্রের। একইভাবে গণতান্ত্রিক হওয়াও শত শত বছর ধরে পরিণত হয় ফ্যাশনে। গণতন্ত্রের সাথে যেখানে সর্বাত্মকবাদ বা স্বৈরতন্ত্রের একেবারে বিপরীতমুখী সম্পর্ক, সেখানে কমিউনিস্ট চীনের সাথেও গণতন্ত্রের ‘গণ’ লাগিয়ে দেয়া হয়। জনগণতন্ত্র, সর্বহারার গণতন্ত্র, মৌলিক গণতন্ত্র, শোষিতের গণতন্ত্র ইত্যাদি নানা নাম দেয়া হয় গণতন্ত্রের।
সাধারণভাবে গণতন্ত্র বলতে বোঝানো হয় লিবারেল ডেমোক্র্যাসি বা উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে। এ ধরনের ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনের মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনকে সুরক্ষা দেয়া হয়। এর মধ্যে আমেরিকার মতো জ্যাকসনিয়ান বা রাষ্ট্রপতি শাসিত অথবা ব্রিটেনের মতো ওয়েস্টমিনস্টার বা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিন্ন ধরন রয়েছে। আবার প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোটিং পদ্ধতি সব দেশে এক রকম নয়। কোনো কোনো দেশে একাধিক প্রার্থীর মধ্যে যিনি বেশি ভোট পান তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয় আবার কোনো কোনো দেশে নির্বাচিত হওয়ার জন্য ৫০ শতাংশের বেশি ভোটপ্রাপ্তির শর্ত রয়েছে।
প্রথম দফায় এই পরিমাণ ভোট না পেলে দ্বিতীয় দফায় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দু’জনের মধ্যে নির্বাচন হয়। আবার কোনো কোনো দেশে ব্যক্তি প্রার্থী না হয়ে দলের ওপর ভোট হয়। প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলের পক্ষ থেকে দেয়া তালিকা অনুযায়ী সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হয়। আবার কোনো কোনো দেশে সংসদ সদস্যের একটি অংশ সরাসরি ভোটে, আরেকটি অংশ দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়।
ভোটিংপদ্ধতি বিবেচনার বাইরে ভিন্ন দুই গণতন্ত্রের একটি হলো সোভিয়েত গণতন্ত্র বা কাউন্সিল গণতন্ত্র। যেখানে স্থানীয় পর্যায়ের শ্রমিকেরা প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। স্থানীয় প্রতিনিধিরা জেলা প্রতিনিধি, এরপর আঞ্চলিক প্রতিনিধি এভাবে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র শাসন করেন। এ ব্যবস্থার সাথে রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা তৈরি করা হয় কমিউনিস্ট দেশগুলোতে।
এর বাইরে আরেকটি গণতন্ত্রের নাম হলো সর্বাত্মকবাদী গণতন্ত্র। এ ধরনের গণতন্ত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় জনগণের কোনো ভূমিকা থাকে না। দলহীন এক ধরনের গণতন্ত্রও রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক দল ছাড়া গোপন ভোটে নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। এ ধরনের অর্গানিক বা কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রে শাসকদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে, তবে তাদের শাসন হয় জনকল্যাণমুখী। বোনাপার্টিজমের সমর্থকেরা এ ধরনের ব্যবস্থার কথা প্রথম ব্যবহার করেন। বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এজাতীয় ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল যখন গঠন করা হয়, সেটার নাম দেয়া হয়েছিল শোষিতের গণতন্ত্র। সোভিয়েত ধাঁচের গণতন্ত্রের সাথে এর কিছুটা মিল রয়েছে। অর্গানিক বা কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের মতো এই গণতন্ত্রের মূলকথা হলো জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্র সব কিছু করবে। এ জন্য কখনো কখনো জনগণকে মতামত দেয়ার সুযোগ দেয়া হলেও এ সুযোগ অবাধ হয় না। ধরে নেয়া হয় যিনি রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে থাকবেন তিনি যা কিছু করেন সব কিছু দেশের জনগণ তথা শোষিত মানুষের কল্যাণে করেন। দল তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। এখানে জনগণের মত দেয়ার প্রয়োজন বা সুযোগ মুখ্য থাকে না। বলা হয়ে থাকে কমিউনিজমের প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারার গণতন্ত্র থেকে ধার করে ১৯৭৫ সালে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে যেমন একটি দল থাকে, তেমনিভাবে একটি দল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সে সময়।
বাংলাদেশে এখন যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে, সেটি লিবারেল ডেমোক্র্যাসির চরিত্র ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। এখানকার গণতন্ত্রকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের চরিত্র দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। যেখানে শাসক দল এতটাই শক্তিশালী হবে যে দেশের বাকি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অবতীর্ণ হোক বা না হোক ক্ষমতা থেকে শাসক দলকে সরানো সম্ভব হবে না। এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মডেলের মধ্যে মালয়েশিয়ান ব্যবস্থা বিশেষভাবে সামনে রয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। মালয়েশিয়ার এই মডেলের স্থপতি মাহাথির মোহাম্মদকে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছে। এই মডেলেই স্বাধীনতার পর থেকে মালয়েশিয়ায় ক্ষমতাসীন শাসক দল আমনো ও বারিসান ন্যাশনালকে কোনো সময় ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। এখানে নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তর লিবারেল ডেমোক্র্যাসির মতো ভোট হয়। কিন্তু ভোটিং ব্যবস্থাকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে জনসমর্থন বিগড়ে গেলেও ক্ষমতাচ্যুতির ভয় থাকে না শাসক দলের জন্য।
বিগত নির্বাচনে বিরোধী জোট পপুলার ভোট বেশি পাওয়ার পরও বিরোধী জোট ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ৭০-এর কাছাকাছি বয়সের বিরোধীদলীয় নেতাকে সমকামিতার অভিযোগে বিচার করে জেল দেয়া হয়েছে, যাতে তার পক্ষে পরেরবার আর নির্বাচন করা সম্ভব না হয়। তবে এ ধরনের সরকার জনকল্যাণমুখী বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। সরকারের কর্মসূচিতে জনতুষ্টির বিষয়টিকে নানাভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়। আর সরকারের প্রশাসন এবং বিচার বিভাগে সরকারের এমনই নিয়ন্ত্রণ থাকে যে, রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চূড়ান্তভাবে সরকারি স্বার্থপরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত প্রশাসন বা বিচার বিভাগ থেকে আসার সম্ভাবনা থাকে না।
নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের এই মডেল আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও অনুসরণ করা হয় যেখানে বহু দল থাকলেও নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে ইচ্ছেমতো প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের মতো শোষিতের গণতন্ত্র সেই অবয়বে আর আসবে বলে মনে হয় না। তবে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের অবয়বে আবার তেমন এক ধরনের শাসনের প্রতিধ্বনি এখন শোনা যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের একেবারে খোলনলছে পাল্টে দিয়ে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এবারের শোষিতের গণতন্ত্রের আগমন ঘটছে ধীরে ধীরে, কিছুটা ভিন্ন অবয়বে। এবারো সংবিধানে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন নতুন আইনও প্রবর্তন করা হচ্ছে। বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা হচ্ছে, কিন্তু খানিকটা ভিন্নভাবে।
নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত, প্রশাসনে রাজনৈতিক নীতিগত নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করা হয়। এ জন্য সরকারি ভাবধারার লোকদের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য নেয়া হয় বিশেষ পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে নিয়োগ-পদোন্নতির পাশাপাশি বিধিগত পরিবর্তনও আনা হয়। তৃতীয় পদক্ষেপ নেয়া হয় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণের। এ তিনটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের প্রধান লক্ষ্য থাকে এক দিকে সরকারি দলের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা, অন্য দিকে বিরোধী দলকে ক্ষমতাহীন ও অকার্যকর করে ফেলা। ৭০-এর দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ক্ষমতা এতটা নিরঙ্কুশ ছিল যে তখন এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। এ ছাড়া তখনকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাপটও ছিল। এখন সেটি আর নেই।
সর্বহারার গণতন্ত্রের আদিভূমি হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ দেশটিতে কমিউনিজম বিলুপ্ত হওয়ার পর একই সাথে রাষ্ট্রটাই ভেঙে পড়ে। সৃষ্টি হয় অনেকগুলো প্রজাতন্ত্র। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতন্ত্র হলো রুশ ফেডারেশন। আমরা সংক্ষিপ্তভাবে যেটাকে রাশিয়া বলে জানি। সর্বহারার গণতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর রাশিয়ায় নির্বাচনভিত্তিক বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে। এই বহুদলীয় নির্বাচনে এখন যিনি প্রেসিডেন্ট সেই ব্লাদিমির পুতিন পর পর দু’বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সংবিধানের সীমাবদ্ধতা থাকায় একবার প্রধানমন্ত্রী থেকে আবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তিনি। রাশিয়ার নির্বাচনে আরো কয়েকটি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, কিন্তু সব নির্বাচনে বিজয়ী হয় পুতিনের দল। পুতিন বিরোধী দলগুলোকে এমনভাবে সাইজ করে রেখেছেন যে তাদের পক্ষে নির্বাচনে জেতা সম্ভব হয় না। বিরোধী দলে থাকলে শান্তিতে ব্যবসায়-বাণিজ্য করা যায় না। কারণে-অকারণে মামলা হয়। প্রতিবাদ জানালে যেতে হয় জেলে।
পুতিনের রাশিয়া ছাড়াও এ রকম গণতন্ত্র মধ্য এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে রয়েছে। মিসর, আলজেরিয়া তিউনিসিয়া, সুদানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে দীর্ঘ দিন ধরে এ ধরনের বহুদলসর্বস্ব একদলীয় গণতন্ত্র বিরাজ করেছে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর দুই দশক এ ধরনের গণতন্ত্র কম-বেশি কায়েম ছিল। ৯০-এর পর সে ধারার পরিবর্তন হয়। এর দুই দশক পর নতুন পরিবেশে কয়েক দশক আগের পুরনো ব্যবস্থাকে নতুন অবয়বে বিন্যাস করার আয়োজন চলছে। ভিন্ন অবয়বে কায়েম হতে চলেছে শোষিতের গণতন্ত্র। এ জন্য মোড়কের পরিবর্তনটা ছিল অবশ্য সময়েরই দাবি।