সংলাপ বা সমঝোতা নয়, দমনের মধ্যেই চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের পথ খুঁজছে সরকার। সে লক্ষ্যেই সরকারবিরোধী জোটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। আন্দোলন দমনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযানও শুরু হয়েছে। এতে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এভাবে দমন কৌশলের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত এগিয়ে যেতে চান সরকারের নীতি নির্ধারকেরা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বিরোধী জোটের চলমান লাগাতার অবরোধ মোকাবেলায় দেশব্যাপী ব্যাপক গ্রেফতার অভিযান ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যেও একের পর এক প্রাণহানি, জ্বালাও পোড়াও, ভাঙচুর ও বোমাবাজিসহ সহিংস ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের পরও এসব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে সারা দেশ থেকে রাজধানী ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সরকারবিরোধীরা। টানা অবরোধ ও হরতালে চরম ঝুঁকির মুখে দেশের অর্থনীতি। এ অবস্থায় সরকারের ওপর দেশ-বিদেশের নানামুখী চাপও বাড়ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষমতাসীন জোটেরও চাপ রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে কোনো ধরনের সংলাপ বা সমঝোতার পথে না হেঁটে দমনের মাধ্যমেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আন্দোলন দমনে বারবার কঠোর হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকেরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারবিরোধীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সহ্যের একটা সীমা আছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা যা দরকার সরকার তাই করবে। তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এসব নাশকতা দমন করতে প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে।
একই বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন সরকারের অন্য শীর্ষ নেতারাও। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। বিএনপিকে আইএস এবং আলকায়েদার মতো দমন করা হবে জানিয়ে গতকাল খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, আইএস ও আলকায়েদার সাথে যেমন আলোচনা না করে তাদের নির্মূল করা হয় সে রকম বিএনপিকেও নির্মূল করা হবে। আগামী দশ দিন পর আন্দোলনকারীদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরকারের এমন মনোভাবের কারণে বিশৃঙ্খলাকারীদের প্রয়োজনে গুলি করা হবে বলে সতর্ক করে দেন বিজিবির মহাপরিচালক। নাশকতাকারীদের প্রাণ নিয়ে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছেন র্যাবের মহাপরিচালক। পুলিশের আইজি ও ডিমপি কমিশনারও নাশকতাকারীদের কঠোরহাতে দমনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হরতাল ও অবরোধের নামে মানুষ হত্যার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রীকে দায়ী করে তাকে হুকুমের আসামি করা হতে পারে বলে হুমকি দিয়েছেন। এরই মধ্যে বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কারাবন্দী করা হয়েছে। একাধিক মামলায় আসামি করে ফেরারি করা হয়েছে অন্য শীর্ষ নেতাদের। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, নানা ইস্যু থাকলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট গত এক বছর সরকারবিরোধী বড় ধরনের কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সে জন্য গত ৫ জানুয়ারি ঘিরে শুরু হওয়া এ আন্দোলনও তারা শেষ পর্যন্ত সফল করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই এখন আর সংলাপ সমঝোতার দরকার নেই, অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কেবলই দমনের মাধ্যমে বিরোধী জোটকে আরো কোণঠাসা করে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যাবে। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যা যা করার তার সবই করা হবে সরকারের তরফ থেকে। বিশেষ করে বিরোধী জোট ভাঙা, জোটের শরিক জামায়াতকে নানা চাপে আন্দোলন থেকে সরে আসতে বাধ্য করা, বিএনপিকে ভেঙে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সরকারের পক্ষে টানা এবং সর্বশেষ মামলা, হামলা করে সরকারবিরোধী আন্দোলন কঠোরহস্তে দমনের চেষ্টা করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, সরকারের এমন মনোভাব নতুন নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরেও একইভাবে বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের দমন করা হয়েছিল। ফলে গত এক বছর দেশের পরিস্থিতিও শান্ত ছিল। তাই বিরোধী জোটের সাথে কোনো রকম সংলাপ বা সমঝোতায় না গিয়ে দমনের মাধ্যমে এখন কঠোর অবস্থানের দিকেই মনোনিবেশ করছে সরকার।
বিএনপির আন্দোলনকে ‘লেপ-তোশক’ আন্দোলন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ড. নূহ উল আলম লেনিন নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপি লেপের ভেতর শুয়ে শুয়ে আন্দোলন করছে, তারা স্বপ্ন দেখছে, এভাবে একদিন সরকারের পতন হবে। লেপ-তোশকের মধ্যে শুয়ে স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্ন কোনো দিন সফল হবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন কোনো আন্দোলন হচ্ছে না। আর বিএনপির নেতাকর্মীরা যেভাবে রাস্তাঘাটে হামলা চালাচ্ছে এটাকে আন্দোলন বলা চলে না।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি বলেন, আমরা সংলাপ নিয়ে ভাবছি না। কারণ বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করেছিল। কিন্তু জনগণ আমাদের পাঁচ বছরের জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছেন। তাই যা হওয়ার ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় হবে। এর আগে নয়।
বিরোধী জোটের আন্দোলনের মুখে সরকার সংলাপ বা সমঝোতায় বাধ্য হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপি আর কী আন্দোলন করবে। তাদের কেবল এক মামলা দিয়েই ঠাণ্ডা করে দেয়া যায়। মামলা ও গ্রেফতারের ভয়ে আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে পিঠ বাঁচানোর জন্যই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে সবাই। অতীতেও তাই দেখা গেছে। এ জন্য সরকার আরো কঠোর হবে ও শেষ পর্যন্ত তাদের দমন করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে জনবিচ্ছিন্ন, কর্মীবিচ্ছিন্ন বিএনপি এখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের পথ বেছে নিয়েছে, চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। মূলত দেশকে অস্থিতিশীল করতে, দেশের উন্নয়নকার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে বিএনপি এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। জঙ্গিবাদী এ গ্রুপের আক্রমণ থেকে দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। তাই তাদের কঠোরহাতে দমন করা হবে। এ ক্ষেত্রে যা যা করার সরকার তা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজ বলেন, বিএনপির এই আন্দোলন এখন জঙ্গিদের মতো হয়ে গেছে। ফলে এই আন্দোলন বেশি দিন টিকবে না। সামনের দিকে এগোতে পারবে না। তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম মোকাবেলা করতে সরকারের কৌশল আছে, রাজনৈতিকভাবেও তাদের মোকাবেলা করা হবে। তিনি আরো বলেন, দেখবেন কিছু দিন পরে শেষ হয়ে গেছে। আন্দোলনের নাম-নিশানা কিছু নেই। তাদের আন্দোলন ব্যর্থ হবেই।