বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের কারণ কী? জঙ্গিবাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি কি ভারত!

বিশ্বের জঙ্গিবাদের ঢেউ বাংলাদেশেও ধাক্কা দিচ্ছে। জঙ্গিবাদকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে হলে অবশ্যই এই প্রশ্নের একটি গ্রহণযোগ্য উত্তরের সন্ধান করা দরকার, কেননা, যে কোনো কাউন্টার-টেরোরিজম কৌশলের প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে, প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং তার উৎসের দিকে তাকানো৷ এই প্রশ্নটি কেবল যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, যে কোনো দেশের ক্ষেত্রেই তা সমপরিমাণে সত্য৷

বাংলাদেশে গত প্রায় তিন বছর ধরে জঙ্গিবাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং সাম্প্রতিককালে উপর্যুপরি বড় ধরণের হামলার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে একটি প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছে – বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কারণ কী?

বাংলাদেশে বর্তমান যে জঙ্গিবাদ তার শেকড় খুঁজতে গেলে আমাদের দৃষ্টি নিতে হবে তালেবানের উত্থানের সময়টিতে। ৮০-এর পর বাংলাদেশ থেকে অনেক ইসলামিক যোদ্ধা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তানে যায়। যুদ্ধে অনেকে নিহত হয় অনেকে যুদ্ধ শেষে ফিরে আসে। তালেবান হল সুন্নি ওহাবী গোষ্ঠী। যারা তালেবানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে তারা যুদ্ধে যাওয়ার আগে ওহাবী কিংবা সালাফি ছিল কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও তারা যে ফিরে আসার সময় ওহাবী মতবাদ মাথায় করে নিয়ে এসেছে তা স্পষ্টভাবে বলা সম্ভব। দেশে এসে তারা বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ তৈরি করে কেউ বা মসজিদ মাদ্রাসার প্রধান হয়ে বসে। সুতরাং মাদ্রাসায় ইসলামিক শিক্ষার নামে বলে বলে ওহাবী মতবাদের প্রসার আর মসজিদের খুতবায় চলে ওহাবীদের পক্ষে প্রচার। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বীজ বপনের কাজটি হয়েছে সেসময়।
সময়ের পরিক্রমায়, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রশ্রয় ও মদদে চলে জঙ্গিবাদ বিস্তার। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারে বিভিন্ন এনজিও, দাতবসংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন ও ব্যাংক প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ যে জঙ্গিবাদের বিস্তার হয়েছে তা একদিনে হয়নি। রুট লেভেল থেকে শুরু করে আপার লেভেল পর্যন্ত বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন নামে জঙ্গি-মতবাদের বিস্তার করে চলছে। ফলে বিভিন্ন সময় সরকার এসব সংগঠন কিংবা দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধী দল জামাতী ইসলামের ছাত্র সংগঠন জঙ্গিবাদের সৈন্য সংগ্রহের প্রাথমিক স্তর হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে অনেক জিহাদী কিংবা জঙ্গি জামাত কিংবা শিবির ত্যাগ করে আরো বেশি রেডিক্যাল সংগঠনের সাথে যুক্ত হচ্ছে। এর মূল কারণ মতবাদ ও কার্যক্রম সম্পর্কে ভিন্ন-পন্থায় বিশ্বাসী। আমরা স্মরণ করতে পারি সারা দেশে বোমা হামলা করে জানান দেওয়া জেএমবি দলটির কথা। যারা সবাই ছিল জামাত, শিবিরের সাবেক সদস্য।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সবসময় জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক ফায়দা হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। ২০০৩ সালে বাংলা ভাইদের প্রথম গ্রেফতার করা হয়েছিল জয়পুরহাটে। জঙ্গি হিসেবে তাদের বিরুদ্ধেও মামলাও হয়। তবে তাদের কোনও শাস্তি হয়নি। তখনকার প্রশাসন তাদের বের করে আনার পক্ষে ছিল। পরবর্তীতে যে এসআই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমানদের গ্রেফতার করেছিলেন, পরবর্তীতে তার চাকরি চলে যায়। এই একটি ঘটনা বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও বিস্তার সম্পর্কে অনেক কিছু প্রমাণ করে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সংকারের আমলেও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে হিজবুত তাহরীর মতন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে বড় কোন অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। অবশেষে পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম; সরকার ও সরকারী উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সন্তানরা এসব জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িত। গুলশান হামলার পূর্বে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ও সড়কে হিজবুত তাহরীর পোস্টার প্রচারণা চললেও কেন পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নেয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক ফায়দা হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হিসেবে স্মরণ করতে পারি; ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে জঙ্গি সংগঠন হুজির গ্রেনেড হামলা ও পরবর্তী রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য।
যাই হোক, এখন আমরা দেখব জঙ্গিবাদ বিস্তারে বিভিন্ন সংগঠন, দলের নিষিদ্ধে তালিকা। এছাড়াও থাকছে বিভিন্ন সময় জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলায় আহত ও নিহতদের পরিসংখ্যান। ব্লগটি বাংলাদেশের জঙ্গি হামলার প্রতিটি ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও লিপিবদ্ধ করা অব্যাহত থাকবে।
উগ্রবাদী দলগুলো নিষিদ্ধের তালিকা
২০০৩: ছয়টি উগ্রবাদী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা।
সাহাদাত-ই-আল হিকমা-ফেব্রুয়ারি ৯, ২০০৩
জামায়েতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি এবং জাগ্রত মুসলিম বাংলাদেশ বা জেএমজিবি-ফেব্রুয়ারি ২৩. ২০০৫
হরকতুল-আল জিহাদ আল-ইসলাম (হুজি)-অক্টোবর ১৭, ২০০৫
হিজবুত তাহরীর- অক্টোবর ২২, ২০০৯
আনসার উল্লাহ বাংলা টিম ২৫ মে, ২০১৫
২০০৯ এপ্রিল মাসে সাতটি সংগঠনকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল সরকার:
হিজবুত তাহরীর, ইসলামি সমাজ, ওলেমা আঞ্জুমান আল বাইনিয়াত, ইসলামিক গণতন্ত্র দল, তওহিদ ট্রাস্ট, তামির উদ্দীন এবং আল্লাহ দল।
২০১৩ সালের অগাস্টে আরো দুইটি দলকে কালো তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়:
শাহদাত-ই নবয়ুত ও আল মারকজুল আল ইসলাম
২৩ জেলায় জঙ্গি তৎপরতা :
গোয়েন্দাদের তথ্যানুযায়ী রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, রংপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, পাবনা, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, টেকনাফ ও সিলেট জেলায় এখনো জঙ্গি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
নিষিদ্ধ চারটি আত্মস্বীকৃত জঙ্গি প্রতিষ্ঠান:
শাহাদাত-ই-আল হিকমা (2004), জমিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি,2005), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি,2005) ওহরকাতুল জিহাদ (2005)!
শুধুমাত্র বাংলাদেশেই ৩০টি কিংবা তারও বেশি জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংগঠনগুলো:
মুজাহিদ অফ বাংলাদেশ, কালো তালিকাভুক্ত ইসলামী সমাজ, দাওয়াতে ইসলাম, ওলামা আঞ্জুমান আল বাইয়্যিনাত, ইসলাম ও মুসলিম, হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশ, আল হারাত আল ইসলামিয়া, জামায়াতুল ফালাইয়া, তাওহিদী জনতা, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, জুম্মাতুল আল সাদাত, শাহাদাত-ই-নবুওয়াত, জামায়াত-ই-ইয়াহিয়া আল তুরাত, জইশে মোস্তফা বাংলাদেশ, আল জিহাদ বাংলাদেশ, ওয়ারাত ইসলামিক ফ্রন্ট, জামায়াত-আল-সাদাত, আনসার রাজশাহী, আল খিদমত, হরকত-এ ইসলাম আল জিহাদ, মুসলিম মিল্লাত শারিয়া কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট ফর জিহাদ, জইশে মোহাম্মদ, আল ইসলাম মার্টায়ারস ব্রিগেড, লস্কর-ই-তৈয়্যবা, হিযবুল্লাহ ইসলামী সমাজ, হরকাতুল মুজাহিদীন, নুসরাতুল মুসলেমিন, ইসলামী জিহাদ আন্দোলন বাংলাদেশ ও ইসলামী ছাত্রশিবির,কতল বাহিনী, শহীদ নাসিরুল্লাহ খান আরাফাত ব্রিগেড, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি, তামির-উল-দীন বাংলাদেশ, তাওহিদ ট্রাস্ট।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো:
পাকিস্তানের লস্করই তাইবা, হরকত উল মুজাহিদ, জম্মু ও কাশ্মির স্বাধীনতা ফ্রন্ট (LKLF), জোশ-ই মুহাম্মদ (JeM), জোশ-ই মোস্তফা, ভারতের কাশ্মীর ভিত্তিক সংগঠন-আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্স (ARCF), তাহরিক-ই-জাভেদ-ইসলামি কাশ্মির (TJI), হরকতুল জিহাদুল ইসলামি, হিজবুত-উল-মুজাহেদিন, হেজবি ইসলামি, জামাত-উল-মুজাহেদিন এবং হরকত-উল-আনসার।
মায়ানমার ভিত্তিক জঙ্গি গ্রুপ:
রোহিঙ্গা সংহতি সংস্থা -Rohingya Solidarity Organisation (RSO)
আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল সংস্থা -Arakan Rohingya National Organisation (ARNO)
ন্যাশেনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরাকান -National United Party of Arakan (NUPA)
আরাকান রোহিঙ্গা ফোর্স- Arakan Rohingya Force
ইসলামিক সংহতি ফ্রন্ট- Islamic Solidarity Front
আরাকান পিপলস আর্মি- Arakan People’s Army
লিবারেশন মায়ানমার ফোর্স-Liberation Myanmar Force
আরাকান মুজাহিদ পার্টি- Arakan Mujahid Party
রোহিঙ্গা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফোর্স- Rohingya Independents Force
রোহিঙ্গা ইনডিপেন্ডেন্স আর্মি- Rohingya Independence Army
রোহিঙ্গা পাট্রিয়টিক ফ্রন্স- Rohingya Patriotic Front,
রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট এবং ইউনাইটেণ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশান-Rohingya Islamic Front and United students Association of Arakan Movement (USM)
আকামুল মুজাহিদিন (এএমএম)-Akamula Mujahideen
হারাকাহ আল-ই

You may also like...

Read previous post:
গুম থেকে ফিরে আসার পর মুখ খুলতে মানা

গুম রাজ্য থেকে ফিরে এসেছেন সাংবাদিক উৎপল দাস। ওদিকে তিনি দাবী করেছেন, গুম নয়, বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি ! কিন্তু গুম...

Close