আত্ন জিজ্ঞাসা

হ্যা, আমি একজন সমকামী

এই যে কথাটি বললাম, তাতে করে আমার কুন্ঠা নেই। নেই কোনো লজ্জা, জড়তা কিংবা ভয়। একটা সময় ভয় পেয়েছি, লজ্জিত হয়েছি, ভেতরে ভেতরে মরমে মরে গিয়েছি আমার এই সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে।

জীবন আমাকে ধীরে ধীরে এই অকারণ গ্লানি থেকে মুক্তি দেবার পথ দেখিয়েছে। সমাজের আর দশটা স্ট্রেইট ব্যাক্তি যদি বলতে পারে যে তাঁরা স্ট্রেইট, তাহলে আমি কেন বলতে পারব না যে আমি একজন সমকামী? আমি কি একজন মানুষকে ভালোবেসে তাহলে কোনো অপরাধ করেছি? কেন আমি এইভাবে নিজেকে নিজেকেই অপরাধী হিসেবে তুলে ধরব?

এই সমাজ, সংসার, সামাজিক প্রেক্ষাপট যা-ই বলেন না কেন, প্রত্যেকটা জিনিস এই সমাজে যেন প্রি ডিটারমাইন্ড। যেটি সহজে হচ্ছে না সেটি নেবার কোনো ঝোঁক এই সমাজে নেই। একজন পুরুষ একজন পুরুষের প্রতি যে আকৃষ্ট হতে পারে, এই কথা মেনে নিতে সমাজ কেন আড়ষ্ট হবে?

এই আড়ষ্টতা হচ্ছে সমাজের একটা চরিত্র। যেই চরিত্রকে আমি বলি অন্যায়। এই স্টেরিও টাইপড সমাজ যে একটা পার্টিকুলার চিন্তায় ধাবিত হয় সেটিকে ভাংতে হবে, সেটিকে ক্ষুণ্ণ করে সামনে এগোতে হবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে সমকামিতাকে অন্যায় হিসেবে গণ্য করা হয় আইনী ভাবে। আর সমাজ-ও এটিকে গ্রহণ করতে পারেনা। একজন নারী নারীর সারথে প্রেম করবে কিংবা একজন ছেলে ছেলের সাথে প্রেম করবে এই ব্যাপারটা সমাজই মেনে নিতে পারেনা আর সেটি পারেনা বলেই এই তথাকথিত মূল্যবোধের ছায়া পড়ে ওই সমাজের আইনে কিংবা বিধিতে বা আচরনে। যেমন বাংলাদেশের পেনাল কোডের ৩৭৭ নাম্বার ধারায় সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে সমাকামিতার শাস্তি হিসেবে ১০ বছর কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হবে। এটা কি সভ্য সমাজের আইন হতে পারে? এটি কি একটি সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে?

আমি তাই এই সমাজ, এই সমাজের রীতি ও চিন্তার এই স্টেরিও টাইপড প্রকরণকে ভাঙতে চাই। আর চাই বলেই আমার বলবার সূচনা।

ইসলাম ধর্ম বলেন কিংবা অন্য কোন ধর্ম বলেন, এগুলোর তৈরী-ই হয়েছে আমাদের পায়ে বেড়ী পরাতে। আমি কাকে ভালোবাসব নাকি বাসব না এটি কেন ধর্ম নির্ধারণ করবে? মুহাম্মদের মত এমন একজন বদমায়েশ লোক যে কিনা নিজেই বিয়ে করেছে ১৩ টা আবার এদের ভেতর রয়েছে ৬ বছরের মাসুম বাচ্চা। সেই লোকের বলা একটা অস্তিত্বহীন ধর্মের জন্য বাংলাদেশে আমরা আমাদের পছন্দমত বিয়ে করতে পারিনা, বলতে পারিনা। এটা কেমন কথা? এটা কেমন অবিচার।

আমেরিকা টেক্সাস-এর রাইস ইউনিভার্সিটিতে পাঠরত একজন দর্শনের ছাত্র রেইনার এবার্ট নামে একজন সাংবাদিক এই বিষয়ে “বাংলাদেশে অদৃশ্য সংখ্যালঘু” প্রবন্ধে বলেন-

স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মক্ষেত্রে LGB দের প্রতি বৈষম্য তাদের স্বাস্থ্যসেবা এবং সুবিচার থেকে বঞ্চিত করে। প্রায়শঃই আতঙ্ক, সংশয় এবং অপরাধবোধের মধ্যে ক্লিষ্ট থেকে তারা পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের কাছ থেকে খুব কমই সহায়তা পায়। বাংলাদেশ পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, সমলিঙ্গের মধ্যে যৌণ মিথস্ক্রিয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড। ফলশ্রুতিতে, খুব কম জনই তাদের যৌন প্রবনতা বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলে। অধিকন্তু, বেশীর ভাগই বাধ্যতামূলক গোঁড়ামী, দিকভ্রষ্ট ধারণা এবং সুবিচার আর নৈতিকতার পরিহাসের বেড়াজালে পড়ে মিথ্যা ও গোপনীয়তার জীবন যাপনে বাধ্য হয়। এখনও নারীদের জীবনের মোক্ষ হিসেবে বিপরীতগামী (heterosexual) বিবাহ বিবেচিত, আর সমকামী নারীদের প্রতি সহনশীলতা বিশেষভাবে কম। তারা দ্বিগুন ভাবে নিষ্পেষিত।

২০০২ সনে বাংলাদেশের সমকামী পুরুষদের (Men sex who have sex with men বা MSM) সবচেয়ে বৃহত্তর সংগঠন বন্ধু স্যোসাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (Bandhu Social Welfare Society বা BSWS) ১২৪ টি স্বচিহ্নিত নারী সমকামী এবং উভকামী পুরুষদের উপর জরিপ চালায় যা তর্ক সাপেক্ষে স্থানীয় LGB গোষ্ঠীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ। প্রতি দুই জনের মধ্যে একজন সাক্ষাৎদানকারী বলেছে যে, সে স্কুল বা কলেজে হয়রানির শিকার হয়েছে। প্রতি চার জনের মধ্যে তিন জন, যারা তাদের আত্মীয় পরিজনকে নিজের যৌন প্রবণতা সম্পর্কে জানিয়েছে। তারা বলেছে যে তারা তাদের পরিবারের কাছ থেকে খুব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে; যেমন মারধর, বিয়েতে বাধ্য করা, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত, বাড়ি থেকে বের করে দেয়া অথবা তাদের সমকামীতা থেকে আরোগ্যের জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। অনেকেই আইন প্রয়োগকারী সদস্য, স্থানীয় মস্তান, বন্ধুস্থানীয় কেউ অথবা পরিবারের কোন সদস্য দ্বারাও নিগৃহিত হয়েছে। জরিপে ৮০ জনের মধ্যে ২৯ জন BSWS কে এই মর্মে রিপোর্ট করেছে যে, তারা আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের দ্বারা হয়রানীর শিকার হয়েছে অথবা পুলিশ অফিসাররা তাদের ধর্ষন সহ বিভিন্ন যৌন নিপীড়ন চালিয়েছ। অন্যান্যরা তাদের উপর মারধর, বলপ্রয়োগে অর্থ আদায়, গতিবিধি বাধাগ্রস্ত করা, হুমকি এবং ব্ল্যাকমেইল করার কথা জানিয়েছে। ময়মনসিংহ, ঢাকা এবং সিলেটের সমকামীরা রিপোর্ট করেছে যে, তাদের পুলিশ ব্যারাক বা পুলিশ চৌকিতে ধরে নিয়ে গিয়ে দলগত ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ধরনের জবরদস্তি যৌণক্রিয়া খুবই অনিরাপদ যা প্রায়শইঃ গুরুতর শারীরিক জখমের কারণ হয়; যেমন মলনালী ফেটে যায়, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরন হয় ইত্যাদি। ২০০৩ সালে হিউম্যান রাইট ওয়াচ (HRW) –এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এ ধরনের ঘটনাগুলো মাঝে মধ্যেই ঘটে এবং এ থেকে বাংলাদেশে LGB গোষ্ঠীর উপর সহিংসতার ধরনই প্রকাশ পায়।

বাংলাদেশে সমকামীদের প্রতি স্থানিক তীব্র আতঙ্ক ও ঘৃণার কারণে LGB দের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুখ-সমৃদ্ধির উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রমুখের দ্বারা পরিচালিত ১০২ জন সমকামী পুরুষের উপর এক সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে যে, এদের মধ্যে শতকরা ৩২ জনের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার নজির রয়েছে এবং শতকরা ৪৭ জন অন্ততঃ একবার হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

এই প্রবন্ধ থেকেই আসলে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারা যায়। কি ভয়াবহ একটা ব্যাপার। শুধু নিজের ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে কিংবা ভাবতে গিয়েও বাঁধার সামনে পড়তে হচ্ছে। আমরা কি আসলেই সভ্য সমাজে বসবাস করছি? আমরা কি আসলেই মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি? এই ধর্ম, ধর্মের যতসব ট্যাবু, কাল্পনিক বিষয়াদি ভাংতে না পারলে আমাদের আর মুক্তি নেই। আমি সে কারনেই এই বন্ধ জানালা ভেঙ্গে আলোর দেখা পেতে চাই।

You may also like...

Read previous post:
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতারনার ইতিহাসের নাম আওয়ামীলীগ

ঐতিহাসিক পলাশী দিবস আজ। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসাবে ২৩শে জুন। এটি আমাদের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ১৭৫৭ সালের ২৩সে জুন ভাগীরথী...

Close