সাংবাদিক উৎপল দাস, একজন গুম ফেরত ভুক্তভোগী বাংলাদেশি নাগরিক। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তিনি এখন দাবী করছেন যে তিনি বেড়াতে গিএছিলেন, গুম হন নাই। যদিও তার গুম ফেরত বিধ্বস্ত চেহারা সেই কথা বলে না। গিয়েছিলেন ক্লিন শেভ চেহারা এবং স্বাস্থ্যবান অবস্থায় কিন্তু ফিরে এসেছেন মুখ ভরতি দাড়ি সাথে লিকলিকে, ভগ্ন স্বাস্থ্য বোনাস হিসাবে।
উৎপল বলেন, ‘যারা আমাকে ধরে নিয়েছিল তারা আমার মোবাইল নিয়ে যায়। এরপর কি হয়েছে আমি জানি না। তারা কি করেছে জানি না। তারা আমার কাছে টাকা চাইতো। আমার কাছে মোবাইল ছিল না। তারা কি করেছে আমি জানি না। আজ আমাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে করে এখানে নিয়ে আসে। চোখ খুলে দেওয়ার পর আমি বুঝতে পারি এটা নারায়ণগঞ্জের ভুলতা।’
দীর্ঘ আড়াই মাস পর নানা জল্পনা কল্পনা শেষে সাংবাদিক উৎপল দাসের খোঁজ মেলেছে। তবে তিনি নিজে ফিরে এসেছেন নাকি তাকে কেউ ফেলে রেখে গেছে সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনো। তবে তার একজন বন্ধু আরেক সংবাদ কর্মী জানাচ্ছেন, তাকে ফেলে রেখে গেছে কেউ। তাকে কেউ ফেলে রেখে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে এত দিন কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে উৎপল পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমি ঘুরতে গিয়েছিলাম, এখন ফেরত আসছি। কোথায় গিয়েছিলাম, কেন গিয়েছিলাম এখন আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না।’ তবে তার চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট!
গত ১০ অক্টোবর রাজধানী থেকে নিখোঁজ উৎপল। গত ২২ ও ২৩ অক্টোবর মতিঝিল থানায় পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি করেন উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস এবং পূর্বপশ্চিমের সম্পাদক খুজিস্তা নূরে নাহরীন। পুলিশের তথ্যনুযায়ী, তার সর্বশেষ অবস্থান ছিল ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর এলাকায়। ১০ অক্টোবর বেলা একটা ৪৭ মিনিট থেকে তার ফোন বন্ধ থাকে। উৎপল নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই সাংবাদিকরা উৎপলের সন্ধানের দাবিতে রাজপথে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করেন।
যেভাবে গুম অপহরণ
তবে উৎপলকে গুম করার কাজটি যে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার, সেটি জানেন প্রায় সব মিডিয়া কর্মীরা। কিন্তু গুম হওয়ার ভয়ে কেউ প্রকাশ করেন না সেকথা। এর আগে ২০১৪ সালের এপ্রিলে পরিবেশ আইনজীবি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবুবকর সিদ্দিককে গুম করার পরে প্রবল চাপের মুখে ছেড়ে দিতে হয়। মানবাধিকার কর্মী ফরহাদ মযহারকে গুম করার পরেও সবাই আঙ্গুল তুলে র্যাবের দিকে। কিন্তু এরা সবাই গুমকারকদের নাম পরিচয় জানলেও প্রকাশ করেন না নিহত হওয়ার ভয়ে। সর্বশেষে গুম তালিকায় যুক্ত হয়েছেন কুয়েত ও ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান।
একথা এখন সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের প্রায় সব গুমগুলি করে ডিজিএফআই, র্যাব, ও গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের নিজস্ব গোপন কারাগারে শত শত গুম হওয়া ব্যক্তিরা আটক আছেন। গোয়েন্দা সুত্র জানায়, মূলত রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে এসব আটকের জন্য বাহিনীগুলোকে ব্লাঙ্ক চেক দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বাহিনীর একাধিক গুম টিম আছে। রাজনৈতিক কারন দেখিয়ে এসব অপহরন ও গুম করলেও বাহিনীগুলো বহু ক্ষেত্রে জিম্মি নাটক করে মোটা অংকের দাও মেরে থাকে। আবার চুক্তিতে প্রচুর অর্থ নিয়ে প্রতিপক্ষ নিধন করার কাজ করে। এমন ঘটনা ঘটাতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত ফাঁস হয়ে যায় নারায়গঞ্জের ৭ মার্ডারের ঘটনা, যেখানে আওয়ামী ত্রান মন্ত্রী মোফাজ্জল চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই র্যাবের সিও লেঃকর্নেল সাঈদ তারেক, মেজর আরিফ ও লেঃ রানা সহ প্রায় ত্রিশ জনের র্যাব ফেঁসে যায়। কক্সবাজারে অপহন করে টাকা আদায়ের ঘটনায় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ডিবি টিম। র্যাবে গুমের ঘটনা ও পদ্ধতি নিয়ে গোপনে সংগ্রহ করা একটি প্রতিবেদন কিছু দিন আগে প্রকাশ করেছিল সুইডিস রেডিও। সেখান থেকে জানা যায় কিভাবে গুমকান্ড করে বাহিনীগুলো।
অপহরন ও গুম পদ্ধতিতে গত ৪/৫ বছর ধরে জামাত নির্মুল এবং বিএনপি দমন কর্মসূচি নির্মমভাবে চালিয়ে যাচ্ছে সরকারী বাজিনীগুলো। এ নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তারা পরোয়া করে না। সূত্র জানায়, ঢাকার কচুক্ষেতে ডিজিএফআই সদর দফরের বিভিন্ন তলায় এবং মাটির তলার শত শত সেলে, পুরাতন ডিজিএফআই অফিসের উপরে ও নীচের সেলে, কুর্মিটোলা বিমান ঘাটির কয়েকটি ইগলু বিল্ডিংয়ে মাটির উপরে এবং নীচের ভবনে শত শত বন্দী আটকে রাখা হয়েছে। উত্তরায় র্যাবের-১ সদর দফরের মাটির তলায় র্যাবের সেলে গুম হওয়া অগণিত হত্যভাগ্যরা আটক রয়েছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্রগুলো। এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বহু সেফ হাউজ তৈরী করেছিল জেনারেল মইনের অবৈধ সরকার। ঐ সব ভবনেও বহু আটক আছে। বাংলাদেশের সীমান্তর্তী ভারতের এলাকা পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম এলাকার অনেকগুলো কারাগার ও সংশোধনাগারেও পাঠানো হয়েছে বেশকিছু বন্দীকে, বিশেষ করে যাদেরকে ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনা করে চাহিদাপত্র দিয়েছিল ভারত। এসব অপহরন ও গুমের সময় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকের উপস্থিত থাকে। রাজধানীতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অন্তত ১১টি অফিস চিহ্নিত করা গেছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিদের গতিবিধি মনিটর করা হয়। এমনকি বড় বড় অপারেশনের সময় এখান থেকে সাপোর্ট দেয়া হয়।
দেড় বছর আগে রাজধানীর গুলশানে আর্টিজান রেস্তেরায় ভয়াবহ হামলার সময় সাজানো হামলাকারীদেরকে ভারতীয় দূতাবাসের গাড়িতে করে নিকটস্থ একটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ফিল্ড অফিসে নিয়ে রাখা হয়, এবং ঘটনার পরে তাদের কাজ শেষে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। তথাকথিত ঐসব জঙ্গিদেরকে আগেই বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানা কৌশলে সংগ্রহ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিক্রুটাররা। পরে ইসলামী জিহাদের কথা বলে দীর্ঘদিন এদেরকে মগজ ধোলাই ও ট্রেনিং দিয়ে বিভিন্ন সাজানো মিশনে পাঠানো হয়। সেখানে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে মিডিয়াতে লাশ দেখিয়ে নানা কল্পকাহিনী প্রচার করে বাংলাদেশের কাউন্টার টেরজিম সেল এবং র্যাব। এসব মিশনের উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশকে একটি ইসলামি জঙ্গিপ্রবণ এলাকা হিসাবে বিদেশের কাছে প্রচার করা। যাতে করে এই অযুহাতে বিনাভোটের হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে বিদেশীরা বাধা না দেয়। কিন্তু জঙ্গি খেলার ভিকটিম এই হতভাগ্যদের কথা কেউ কখনও জানতে পারে না। এমনকি মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে তাদের স্বজনরা মৃতদেহ গ্রহন করতে ও দাফন কাফন করতেও সাহস করে না।
ঢাকা মহানগর বিএনপি সহসভাপতি কমিশনার চৌধুরী আলম (২০১০ সালের ২৫ জুন) এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে (২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল) গুম ছিল বড় ঘটনা। ঐ দু‘টি ঘটনা ঘটায় র্যাব। পরে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্টান্ডিং কমিটির মেম্বার সালাউদ্দিন আহমদকে (২০১৫ সালের ১০ মার্চ) উত্তরা থেকে অপহরন করে র্যাব, প্রায় দু’মাস গুম করে রাখার পরে তাকে ছেড়ে দেয় ভারতের শিংলয়ে। সেখানে তিনি এখন মামলার জালে আটকে আছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিকদের জনপ্রিয় নেতা আমিনুল ইসলামের লাশ পাওয়া যায় ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল, এর কয়েক দিন আগে তাকে অপহরণ করে র্যাব। ২০১৩ সালের নভেম্বর/ডিসেম্বরে সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর বিভিন্ন থানার ছাত্রদলের সভাপতি, সম্পাদক, বা গুরুত্বপূর্ন নেতাকে র্যাব/ডিজিএফআই অপহরন করে নিয়ে যায়, এরূপ সংখ্যা প্রায় ৩০ জনের মত। এই পদ্ধতিতে ভয় ছড়িয়ে দিয়ে তখনকার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। গত বছর আগস্টে জামায়াতে ইসলামির প্রাক্তন আমীর গোলাম আযমের পুত্র রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহেল আযমী আযমী, যুদ্ধাপরাধের বানোয়াট মামলায় ফাঁসিতে নিহত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর পুত্র ব্যারিষ্টার আরমান, এবং যুদ্ধাপরাধের বানোয়াট মামলায় ফাঁসিতে নিহত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি পুত্র হুমাম কাদের চৌধুরীকে প্রকাশ্যেই অপহরন করে ডিজিএফআই ও ডিবি পুলিশ। প্রায় কাছাকাছি সময়ে এ তিনজনকে আটক করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। কয়েকমাস পরে হুমামকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার মুখ বন্ধ থাকে! কেউ জানতে পারেনি গুমকারীদের তথ্য। এর আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর পক্ষে মামলায় সাক্ষী হবার অপরাধে ২০১২ সালে ৫ ডিসেম্বর সুখরঞ্জন বালিকে সুপ্রীম কোর্টের গেট থেকে অপহরন করে ডিবি পুলিশ। কয়েক মাস পরে খবর পাওয়া যায়, সুখরঞ্জন ভারতের জেলে আটক! সুখরঞ্জন বালি ও সালাউদ্দিন আহমদের ঘটনার পরে দেশজুড়ে প্রচার হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর এসব গুমের সাথে ভারতীয়রাও জড়িত আছে। অপহরণ করার পরে ফরহাদ মযহারকে বেনাপোল দিয়ে ভারতের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তবে ঘটনার সাথে সাথে দেশী বিদেশী প্রবল চাপে তাকে ছেড়ে দিয়ে নাটকীয় গল্প পরিবেশন করে আইনশৃঙ্খলার সদস্যরা।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ৫৪০ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ৫৫ জন ছিল এবং ২০১৬ সালে সেটি বেড়ে ৯৭ জনে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৪৫ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সব মিলিয়ে ৩৪৭ জনকে এখনো পাওয়া যায়নি। এদের ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউ কিছু বলতে পারে না। তবে অন্য একাধিক সূত্রের মতে, চলতি বছরের গত ১১ মাসে নিখোঁজ হয়েছেন দুই শ’র বেশি মানুষ। তারা কোথায় আছেন বা আদৌ বেঁচে আছেন কি-না সেটাও জানেন না পরিবারের সদস্যরা।
কিন্তু কিঞ্ছিত বাস্তবচিত্র পাওয়া যায় গুম ফেরত আরও কিছু ভুক্তভোগী দের পরিবার এর সাথে কথা বলে।তারা শুধু যে কক্ষে আটক করে রাখা হয়েছিল সেই কক্ষের বর্ণনা দেন। ভুক্তভোগী কে মুক্তি দেবার সময় সরকারী দুষ্কৃতি কারীরা এই বলে শাসিয়ে দেয় যে এই ব্যাপারে কোন কিছু প্রকাশ করলে পরবর্তী তে তাকে আর কেউ কোনদিন খুঁজে পাবে না। স্বাভাবিক ভাবেই পরিবার এর লোকজন তাদের আপনজন কে জীবিত ফিরে পেয়ে হাফ ছেঁড়ে বাঁচে। বিচার আর পর্দার পেছনের ভয়াবহ ঘটনা পরিক্রমা এভাবেই বরাবরের মত আড়ালেই থেকে যায়।
সূত্রঃ সমকাল, ইত্তেফাক, বাংলাট্রিবিউন