স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে ‘আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নস (সংশোধন) অ্যাক্ট-২০০৩’ অনুসারে ২০০৪ সালে গঠন করা হয় এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নÑর্যাব। বাংলাদেশ পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (তৎকালীন বিডিআর), কোস্টগার্ড, আনসার ও সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের বাছাইকৃত চৌকস কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যদের নিয়ে শান্তি আর সম্প্রীতির স্বপ্নে ঘেরা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শুরু হয় র্যাবের দুর্গম পথচলা। দেশের ওই অস্থিতিশীল অবস্থায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন আপামর জনসাধারণের বুকে আশার আলো ফুটিয়ে তুলবে এই আকাক্সক্ষা নিয়ে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ গঠন করা হয় বিশেষায়িত এই ফোর্স। সন্ত্রাসবাদ, অবৈধঅস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি প্রধানত জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় র্যাব-এর ওপর। জঙ্গিবাদ দমনে বিভিন্ন বাহিনীর চৌকস সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত এই বাহিনী এরই মধ্যে অর্জন করেছে বিপুল সাফল্য এবং এই সাফল্যের মূলে ছিল আপামর জনসাধারণের বিশ্বাস ও সহযোগিতা এবং প্রতিটি সদস্যের দেশপ্রেম।
১৭ আগস্ট ২০০৫ সালে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর থেকে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ জেএমবি সংগঠনটি সর্বসাধারণের কাছে আতঙ্করূপে পরিচিতি লাভ করে। এরই ফলশ্রুতিতে র্যাব গত ২ মার্চ ২০০৬ জেএমবি’র আমির ও সংগঠনের প্রধান মৃত শায়খ আব্দুর রহমান ওরফে এহসান’কে সূর্যদীঘল বাড়ি নং-২২, পূর্ব শাপলাবাগ, সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে ৬ মার্চ ২০০৬ জেএমবি’র সেকেন্ড ইন কমান্ড মৃত মো. সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই’কে রায়পুরা, মুক্তাগাছা ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে র্যাব কর্তৃক জেএমবি’র উচ্চপর্যায়ের নেতা ও শূরা সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ায় জেএমবি ধীরে ধীরে শক্তিহীন হয়ে পড়ে। গত ১ অক্টোবর ২০০৫ রাজধানীর বাড্ডা থেকে হুজির আমির মুফতি আব্দুল হান্নান.দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল পরিমাণ লিফলেট ও পোস্টারসহ এই সংগঠনের সদস্যদের গ্রেপ্তারই প্রমাণ করে যে, সংগঠনটির কার্যক্রম যথেষ্ট গতিশীল। গত ২০ এপ্রিল ২০১০ হিযবুত তাহরিরের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমেদ, ২০ এপ্রিল ২০১০ ঢাকা জেলার মোহাম্মদপুর থেকে হিযবুত তাহরিরের যুগ্ম সমন্বয়কারী কাজী মোরশেদুল হক ওরফে পন্টাবন কে র্যাব গ্রেপ্তার করে। র্যাব অদ্যবধি হিযবুত তাহরিরের বিভিন্ন নেতাকর্মীসহ মোট ২৪০ জনকে গ্রেপ্তার করে।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে, নিরলস পরিশ্রম করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিগত ১১ বছর ধরে র্যাবের সদস্যগণ এভাবেই প্রচুর অপারেশন পরিচালনা করেছে জঙ্গি সংগঠনসমূহের বিরুদ্ধে। দিনে দিনে ভারী হয়েছে র্যাবের সাফল্যের খাতা। যে দায়িত্ব নিয়ে র্যাব শুরু করেছিল তার পথচলা, তাতে তারা কতটুকু সফল, এই পরিসংখ্যান থেকে তা সহজেই অনুমেয়। র্যাব কর্তৃক আটককৃত জঙ্গিদের মধ্যে রয়েছে জেএমবি- ৫৯৩ জন, হুজি ৭৮ জন, হিযবুত তাওহিদ ১৪৪ জন, ইসলাম ও মুসলিম ৬ জন, জায়েস- ই-মোহাম্মদ ৮ জন, হিযবুল মুজাহিদিন ১ জন, লস্কর-ই-তৈয়বা ৬ জন, উলফা ২ জন, খেলাফতে মজলিস ২ জন এবং তাসাউফ মহল-এর ১০ জন। এছাড়া আটককৃত দ্রব্যাদির মধ্যে রয়েছেÑ গ্রেনেড, বোমা, ককটেল ২২৮টি; অস্ত্র (বিভিন্ন প্রকার) ৮১টি; গোলাবারুদ (বিভিন্ন প্রকার) ৪০৮৫টি; গ্রেনেড বডি ৬৫০টি; ডেটোনেটর (বিভিন্ন প্রকার) ১১০০টি; কর্ডেক্স ১০০ ফুট; হাই এক্সপ্লোসিভ ১ কেজি; বাস্টিং মেশিন ১টি এবং সাংগঠনিক বই, সিডি, টেবলেট, অসংখ্য পোস্টার ও লিফলেট।
অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে উগ্রপন্থি কিংবা জঙ্গিবাদের উত্থান অনাকাক্সিক্ষত, তবুও দুর্ভাগ্যবশত জঙ্গিদের যে উত্থান হয়েছে, তাকে যেকোনো মূল্যে দমন করতে হবে। গত এক দশকে এ দেশে জঙ্গিবাদের যে বিস্তার ও নাশকতামূলক ঘটনা ঘটেছে, তাতে শুধু দেশবাসীই নয়, সারাবিশ্ব শঙ্কিত। এহেন পস্থিতিতে সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপ এবং র্যাবের সুপরিকল্পিত অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গি দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে এবং এর ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে বলেই প্রতীয়মান। তবে কষ্টার্জিত এই সাফল্য ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা। আশা করা যায় যে, জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হবে আমাদের এই সোনার বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের নাগপাশ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা।