স্বল্প আয়তনের মধ্যে বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত হয়েও একটি শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর লক্ষ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে উদার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্ম, সে মাটিতে ধর্মীয় জঙ্গিদের উদ্ভব ঘটতে পারেÑ তা একসময় ছিল সকলের কল্পনার বাইরে। জনসংখ্যার আধিক্য, দারিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল মূলত এদেশের প্রধান সমস্যা। শান্তিপ্রিয় মানুষের এদেশে বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে যোগ হয়েছে জঙ্গিবাদ নামক নতুন সমস্যা।
২০০১ সালের দিকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে, সে সময় ওসামা বিন লাদেনের সাহসিকতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে উগ্রপন্থি মতাদর্শের কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে ইসলামিক নাম দিয়ে দল গঠন করা শুরু করে দেয় এবং ইসলামের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার প্রত্যয় নিয়ে গোপনভাবে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। এদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে, এর মধ্য থেকে মানবীয় সুকুমার বৃত্তিসমূহের মৃত্যু ঘটিয়ে হৃদয়কে করা হয় মায়া-মমতা শূন্য। পিতামাতা দূরে থাক, নিজের জীবনের প্রতিও এমন বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করা হয় যে, ‘নিজের জীবনকে নিজের কাছেই এক দুর্বহ বোঝা’ এই অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। এই বোঝা থেকে নিজেকে মুক্ত করে বেহেশতে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি অনুসারে আল্লাহর আইন চালুর জন্য অন্য মানুষ ও নিজেকে হত্যা করা। সুস্থ চিন্তার পরিবর্তে তাদের মাথায় প্রবেশ করানো হয় অসুস্থ চিন্তা ও দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে করে তোলা হয় দেশ ও জাতির প্রতি বিদ্রোহী। সূচনা হয় জঙ্গিবাদ নামক ভয়ংকর অধ্যায়। কিছু দিন পূর্বে আয়মান আল জাওয়াহিরির প্রকাশিত ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশকে নিয়ে তার পরিকল্পনার ঘোষণা দেশবাসীকে সত্যিকারার্থেই চিন্তায় ফেলেছে। মূলত বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। বর্তমান পৃথিবীর প্রতিনিয়তই মুসলিমরা নিগৃহীত হচ্ছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে ধর্মপ্রাণ অনেক মুসলিম আবেগের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে ও জঙ্গি সংগঠনগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে জিহাদি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত সন্ত্রাসবাদের নামে যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করছে, তারা ইসলাম বলতে যে জিনিসটা বুঝে, সেটাকে বলা যায় উগ্রপন্থি বা রিজিড। উগ্রপন্থি সমর্থনকারী দলসমূহ ইসলামিক চিন্তা-ভাবনাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে জনমত সৃষ্টি করার পাশাপাশি দলে জনবল বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে; ফলে ইসলামিক সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়। মূলত জঙ্গি সংগঠনসমূহ তাদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল-কুরআন-এর শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে তাদের মনগড়া কথাগুলো প্রমাণসহ প্রচার করে। ইসলামের জন্য লড়াই করে মৃত্যুবরণ করলে সে জান্নাত লাভ করবে এই অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মাদ্রাসার ছোট শিশু থেকে অর্ধশিক্ষিত জনগণ এবং ধর্মভীরু সাধারণ মানুষকে তাদের আদর্শে সহজে অনুপ্রাণিত করে বিপথগামী করছে এ সকল সংগঠন। সুতরাং তারা মিথ্যা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে জিহাদকে একমাত্র পরিত্রাণের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে জঙ্গিবাদে লিপ্ত হয়।
সার্বিকভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম দেশে ও দেশের মানুষের মধ্যে বিস্তার করার সাথে সাথে যুব সমাজ বিশেষ করে ছাত্র সমাজ জড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে। জঙ্গিবাদও এর বাইরে নয়। সাধারণত বাংলাদেশে যাদেরকে ভবিষ্যতের কর্ণধার হিসেবে তৈরি করা হয় অর্থাৎ স্কলার বা ছাত্রদেরকে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা ধর্মবিষয়ক শিক্ষা দেওয়া হয় না। আবার তারা পড়ালেখা শেষ করে ইসলামবিদ বা ধর্মবিদ হওয়ার চিন্তাও করে না বরং তাদের লক্ষ্য থাকে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আইটি বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি হওয়ার। এতে করে ইসলামের ব্যাখ্যা স্বভাবতই স্কলার বা প-িত-এর হাতে থাকছে না এবং ইসলামের ব্যাখ্যার জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে স্বল্পজ্ঞানী ব্যক্তিদের ওপর, যারা খুব সহজ বলে বিষয়টাকে তাদের মতো করে ইসলাম-এর ব্যাখ্যা দিচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রে ভুল বলে প্রমাণিত হয় বা অপব্যাখ্যা হয়ে সমাজের ক্ষতির কারণ হয়।স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে মূলত ১৯৮৯ সালে। সে সময় ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি’ বা হুজি নামে এদেশে প্রথম জঙ্গি গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করে। অতঃপর ১৯৯৮ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’ বা জেএমবি নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠন। যার প্রধান ছিলেন শায়খ আব্দুর রহমান। অতঃপর ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ বা ‘জেএমজেবি নামক উত্তরবঙ্গে আরেকটি জঙ্গি গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের জঙ্গিরা মূলত আফগানিস্তানের সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফেরত আসা জিহাদি মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের সূচনা ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনেরও আগে থেকে। ২০০০ সালের ২০ ও ২৩ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাস্থলে দুই দফা অভিযান চালিয়ে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা উদ্ধার করা হয়। এছাড়া আফগান ফেরত জঙ্গিরা ১৯৯৯ সালে তিনটি ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনা ঘটায়। এতে ১৮ জন নিহত হলেও আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। ওই বছর সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে যশোরের টাউন হল ময়দানের বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সম্মেলনে। সেখানে গ্রেনেড হামলায় ১০ জন নিহত হয় ও আহত হয় শতাধিক। এছাড়াও ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনার আহমেদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত ও আহত হয় ৫০ জন। আল্লাহর দল নামক একটি সংগঠন কবি শামসুর রাহমানের বাসায় ঢুকে কবির ওপরে হামলা চালায়। ২০০১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এসব বোমা হামলায় ৫৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে ঢাকার পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭ জন, রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ১১ জন, গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরের গির্জায় ১০ জন, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের অফিসে ২১ জন, বাগেরহাট জনসভায় ৯ জন, সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলায় ৪ জন নিহত হয়; আহত হয় কয়েক শতাধিক। জঙ্গিরা সারাদেশে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করে তোলে এবং ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট সারাদেশে ৫ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে জোট সরকার আমলে বোমা হামলা চালিয়ে প্রায় ৬৬ জনকে হত্যা করে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের সিনেমা হলে, ঝালকাঠির ২ আইনজীবী, ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও যাত্রাপালায় বোমা হামলা উল্লেখযোগ্য। এর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর হুজির মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে হামলা হয়।