সম্প্রতি রাঙামাটির বিলাইছড়িতে উনিশ বছরের এক মারমা তরুণী ধর্ষিত হয়েছেন আর তাঁর কিশোরী বোনটি যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন৷ অথচ আইরনিক্যালি বিলাইছড়ি থানা বাংলাদেশের একমাত্র থানা যেখানে গত চার বছরে কোনো অপরাধ মামলা হয়নি৷
কাপেং ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৩৬৪ জন আদিবাসী নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে৷ তার মধ্যে ১০৬ জন শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, ১০০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ৬৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে৷ চলতি বছরের কেবল জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ১০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তার মধ্যে তিনজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছিল সবিতা চাকমা, সুজাতা চাকমা, ছবি মারমা আর তুমাচিং মারমাকে৷ এই নামগুলো ইন্টারনেটে বেশ আলোচিত হয়েছিল৷
ইন্টারনেটে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশিত হবার পরেও অনেক সময় মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় রহস্যময় নীরবতা দেখা যায়৷ এসব ক্ষেত্রে খুব সতর্ক শব্দচয়নে ধর্ষণের খবর প্রকাশ করা হয়৷ কিছুদিন পর এই সংক্রান্ত আর কোনো খবর কোথাও ছাপা হয় না৷ পরবর্তীকালে কখনো কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বা ফলোআপ প্রকাশিত হয় না৷ সম্প্রতি রাঙামাটিতে দুই মারমা বোনের যৌন নির্যাতনের ঘটনাতেও এই চিত্র দেখা যাচ্ছে৷ হঠাৎ করে দুই মারমা বোনের কাভারেজ বন্ধ হয়ে গেছে৷
এই লেখাটির জন্য আমি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্ট, গ্রন্থ এবং অ্যাকাডেমিক জার্নালের সাহায্য নিয়েছি৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এখন আর কোনো আন্তর্জাতিক গবেষণা সম্ভব নয়৷ পাহাড়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার সকল কার্যক্রম, যেমন, গবেষণা, লেখালেখি, সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধান– সবকিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ বিদেশি কেউ, সে হোক পর্যটক, সাংবাদিক বা সরকারি প্রতিনিধি বা স্রেফ কারোর বিদেশি বন্ধু– তাঁকে পাহাড়ে যেতে সরকারি অনুমতি নিতেই হবে৷ আর যদি তিনি সাংবাদিক, গবেষক, অ্যাকাডেমিক হন, তবে তাঁর গতিবিধি গোয়েন্দারা নজরদারি করবেন যাতে পাহাড়ের কোনো খবর বাইরের দেশে প্রকাশ না পায়৷ যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া কোথাও এমন সেন্সরশিপ আরোপ করা হয় না৷
প্রায় প্রতি বছরই পাহাড়ি জনপদে সেটলারদের দ্বারা হামলা-অগ্নিসংযোগ-ভূমি বেদখলের ঘটনা ঘটে৷ ধর্ষণ, জাতিগত হামলা, সেমারিক-বেসামরিক বাহিনীর রেইড, আতংক ছড়ানো-হয়রানী পাহাড়ের নিত্য দিনের ঘটনা৷ মিডিয়া ব্ল্যাকআউট আর মিলিটারি সেন্সরশিপের কারণে অনেক খবর মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায় না৷ ঘটনা যখন বড় আকারে দেখা দেয় তখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে খবর প্রকাশ করা হয়৷ খুব সতর্ক শব্দ প্রয়োগে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপানো সেই নিউজ পড়ে তেমন কিছুই জানা যায় না, কেবল জানা যায় একটা কিছু ঘটেছে! কিন্তু কে ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে, কী তার বৃত্তান্ত, কী তার ইতিহাস,সামনে কে, পেছনে কোন কুশীলব আছে, সামনের দিনে কী ঘটতে যাচ্ছে– এসবের কোনো ধারণা পাওয়া যায় না৷
দেশের বুদ্ধিজীবীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে যে দু কলম কলাম লেখেন, সেটার ব্যবচ্ছেদ করলেও তেমন কিছু পাওয়া যায় না৷ টক-শো বলি, পত্রিকার নিউজ বা তার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার কলাম– সবখানেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মিডিয়া প্রেজেন্টেশন একটা বাঁধাধরা কাঠামো মেনে প্রকাশ করা হয়৷ সেখানে কেসস্টাডি থাকলেও কেসহিস্ট্রি থাকে না৷ এমনকি শাহবাগের সুশীল সমাজের বিক্ষোভ আর আদিবাসীদের বন্ধুদের ভার্চুয়াল প্রতিবাদ– সেখানেও হিস্ট্রিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই৷ সচেতনভাবে বা অচেতনে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আলোচনায় ঐতিহাসিক বাস্তবতার কথা মানুষ বলে না৷ কোন ঐতিহাসিক বাস্তবতা?
পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক বাস্তবতা এটাই যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো একটা সেনা শাসিত এলাকা।৷ দেশের এক তৃতীয়াংশ সেনা সেখানে মজুদ আছে৷ কেন আছে? সেখানে যদি যুদ্ধ না থাকে, তবে কেন রাষ্ট্রের এত যুদ্ধ-যুদ্ধ সাজ? শান্তির বাতাবরণে কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আছে সেনাবাহিনী?
সত্য হচ্ছে, চার দশক আগে পাহাড়িদের দিকে তাক করা মেশিনগানের ব্যারেল বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো নামায়নি৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম পৃথিবীর অন্যতম মিলিটারাইজড এলাকা৷ এখনো সেখানে কাউন্টারইনসারজেন্সি অপারেশন চলমান৷ সেই অপারেশনের শিকার হচ্ছেন নিরস্ত্র নিরীহ পাহাড়িরা৷ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন বা কাউন্টারইনসারজেন্সি একটা দীর্ঘ, সমন্বিত প্রক্রিয়া৷ আমরা বেশিরভাগ লোক মনে করি যে, জঙ্গি গেরিলাদের বিরুদ্ধে আর্মির রেইড, যুদ্ধ, মিলিটারি ক্যাম্পেইন এটাই বুঝি সেনাবাহিনীর ‘উপজাতি বিদ্রোহ দমন’৷ তা নয়৷ এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার অনেকগুলো পর্যায় বা পর্ব আছে৷ এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সামরিক, বেসামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক আর সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়৷
পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউন্টার ইনসারজেন্সির কৌশল হিসাবে বহুমুখী মিলিটারি ক্যাম্পেইন পরিচালিত হয়েছিল৷ যেমন, পরিকল্পিত গণহত্যা, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ, জনমিতি পরিবর্তন, উন্নয়ন আগ্রাসন, সাইকোলজিক্যাল অপারেশন ইত্যাদি৷ ১৯৮০ সালের শুরুতে জিয়াউর রহমান পাহাড়ে সেটলার সেটলমেন্ট করানোর মধ্য দিয়ে এক দীর্ঘ, পর্যায়ক্রমিক, কিন্তু ফলপ্রসূ কাউন্টারইনসারজেন্সির কৌশল বাস্তবায়ন করেন৷ কেবল এই এক ব্রহ্মাস্ত্রেই পাহাড়িদের ইনসারজেন্সি মর্মান্তিকভাবে ঘায়েল হয়েছে৷ যে সেটলাররা আগে সেনাবাহিনীর সাথে ম্যাসাকার বা পাহাড়ি নিধনে অংশ নিয়েছিল, পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী সময়ে তারাই ভূমি বেদখল, জাতিগত হামলা-অগ্নিসংযোগ,ধর্ষণসহ সকল মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা বিশ্বেই বিদ্রোহ দমনের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে ধর্ষণ৷ যুদ্ধ-সঙ্ঘর্ষে অনিবার্যভাবেই যেন নারীরা ধর্ষণের শিকার হন৷ যুদ্ধকালে পরিকল্পিতভাবে নারীদের ধর্ষণ করার ঘটনা ঘটে৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহী আদিবাসীদের জাতিগত নির্মূল করার এবং বিদ্রোহ দমনের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে বাংলাদেশের সামরিক, আধা সামরিক আর বেসামরিক বাহিনী, সেটলাররা পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় মদদে ধর্ষণ করে আসছে৷ জাতিগত নির্মূলের অন্যতম ঘৃণ্য কৌশল হিসাবে নারী ধর্ষণের নজির পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখা গেছে৷ যুদ্ধকালে সামরিক কৌশল অনুযায়ী পরিকল্পিত ধর্ষণের ঘৃন্যতম নজির দেখা গেছে বসনিয়ার যুদ্ধে, সিয়েরা লেওনে, লাইবেরিয়াসহ আফ্রিকার দেশগুলোতে৷ মানবাধিকার সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা একে গনহত্যামূলক ধর্ষণ (জেনোসাইডাল রেপ) বলে থাকেন৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ধর্ষণকে টমাস ফিনি কসোভোর যুদ্ধে সার্বিয়ান সৈন্যদের ধর্ষণের সাথে তুলনা করেছেন৷ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত নিবন্ধে টমাস ফিনি লিখেছেন, ‘‘সেনাবাহিনী বিশেষ করে কমবয়সি বাচ্চা মেয়েদের ধর্ষণ আর যৌন হয়রানির জন্য টার্গেট করতো৷ এই জাতিগত নির্মূলকৌশল কসোভোয় সার্বিয়ান বাহিনীর মতোই৷”
যুদ্ধকালে ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা আকস্মিক কিছু নয়৷ এটা সামরিক রণকৌশলেরই একটা অংশ এবং এটা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়ে থাকে৷ শুধুমাত্র বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করা ছাড়াও প্রতিপক্ষকে ‘উচিৎ শিক্ষা’ দেওয়া, ভয় দেখানো, এমনকি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যও ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্রের মতো ব্যবহার করা হয়৷ অর্থাৎ, এটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেরও হাতিয়ার৷
‘৭১ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের বিচার হয়নি, ভারতে বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত ধর্ষক সেনার বিচার হয় না, পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষক সেনাসদস্য থেকে শুরু করে বেসামরিক সৈন্য, এমনকি সেটলারদেরও বিচার হয় না৷ পাহাড়ে পরিকল্পিত হামলায় পাহাড়িদের শত শত ঘর পুড়িয়ে দিলে, গুম করলে, হামলা করলে কোনো বিচার হয় না৷ পাহাড়ি নারীদের ধর্ষণ করলেও কোনো বিচার নাই৷ ধর্ষক, খুনিরা দিব্যি মুক্তি পেয়ে যায়৷ তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়৷ এর দীর্ঘ ইতিহাস আছে৷ সেই খুনি, সেই ধর্ষকদের রাষ্ট্র রেশন দিয়ে প্রতিপালন করছে৷ রাষ্ট্র তাদের পূনর্বাসন করেছে পাহাড়ে জ্যামিতিক হারে জনমিতি পরিবর্তনের জন্য৷ একে মহিমান্বিত করা হয়েছে সার্বভৌমত্ব রক্ষা, দেশ রক্ষার ন্যাশনালিস্টিক ন্যারেটিভ দিয়ে৷ তবু কি একে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বলা যাবে না? এটা কি রাষ্ট্রীয় ধর্ষণ নয়? কেবল ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ সালেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মাল্যা, লোগাং আর ন্যান্যারচরে তিনটি ম্যাসাকার (গণহত্যা) সংঘটিত হয়৷ নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে (আর্মি, সাবেক বিডিআর অর্থাৎ এখনকার বিজিবি, এপিবিএন আর আনসার) বাঙালি সেটলাররা এই ম্যাসাকারে অংশ নিয়েছিল৷ এই ম্যাসাকারের সাথে সংঘটিত ধর্ষণের মধ্যে ৯৪ শতাংশ করেছে নিরাপত্তা বাহিনী৷ ধর্ষিতাদের ৪০ শতাংশই ছিল নাবালিকা, শিশু৷
বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিচার না করাটা বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা৷ কাশ্মীরের মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনার উল্লেখ করার সময় মিডিয়াতে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ কথাটার উল্লেখ হয় আর বাংলাদেশের বেলায় সার্বভৌমত্ব রক্ষা! তো একে যা-ই বলুন ‘ব্লাইন্ড স্পট অব ন্যাশনালিজম’, অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক ভন্ডামি কিংবা ভ্রান্তিবিলাস ; ইতিহাসে লেখা হবে যে, পাহাড়িরা বৃহৎ নরগোষ্ঠী দ্বারা মানব ইতিহাসের অন্যতম বর্বর ও নৃশংস নিপীড়নের শিকার হয়েছে৷
অধ্যাপক মার্ক লেভিন পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীর ধর্ষণ প্রসঙ্গে লিখেছেন,
‘‘গনধর্ষণ, বিশেষ করে কমবয়সি মেয়েদের ধর্ষণসহ অঙ্গচ্ছেদ এবং ধর্ষণপরবর্তী হত্যা ছিল অন্যতম বিরামহীণ নৃশংসতার এক কৌশল৷ গোটা জুম্ম জনগনকে সাজা দেওয়া আর কলংকিত করা ছিল এর উদ্দেশ্য৷ ধর্ষিতাকে সমাজ আর পরিবার কলঙ্কিত বলে আর গ্রহণ করে না৷ তাই এই গনধর্ষণের ফলে শিশুর জন্মরোধ করার চেষ্টা করা হয়৷ লোকলজ্জা আর ভয়ের দীর্ঘস্থায়ী এক মানসিক আঘাতে (সাইকলজিকেল ট্রমা) আক্রান্ত হয় ধর্ষিতা আর তার পরিবার৷ স্পষ্টই এই আক্রমণ রাষ্ট্ররচিত নীর্মূলিকরন কর্মসূচির একটি অংশ৷”
পাহাড়ি নারীদের এথনিক ক্লিনজিংয়ের কৌশল হিসাবে ধর্ষণ করা হয়েছে– এ কথা আজ বাংলাদেশের কেউ বলবে, এমন আশা করা বাতুলতা৷ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই ধর্ষণ জুম্ম জাতি নির্মূলের হাতিয়ার বা কাউন্টার ইনসারজেন্সি ট্যাকটিক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে৷ শুরু থেকেই পাহাড়িদের প্রশ্নে রাষ্ট্রের পলিসি ছিল এসিমিলেটিভ৷ শেখ মুজিব পাহাড়িদের বাঙালি বানাতে চেয়েছিলেন৷ এই ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন পলিসি অনুযায়ীই পাহাড়ে সামরিকায়ন শুরু হয়েছিল৷ নতুন রাষ্ট্রের সূচনায় ১৯৭৩ সালে দীঘিনালা হাই স্কুল মাঠে জনৈক সামরিক অফিসার লেফটেন্যান্ট কবির ফরমান জারি করেছিলেন, ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেক উপজাতি মহিলার গর্ভে একটা করে মুসলমান বাঙালি সন্তান জন্ম নেবে৷” কাউন্টার ইনসারজেন্সির অন্যতম লক্ষ্যই ছিল সেটলারদের মাধ্যমে পাহাড়িদের বাঙালি বানানো৷ ইখতিয়ার উদ্দিন জাহেদ লিখেছেন, ‘‘(বাংলাদেশ) আর্মি তাদের কৌশলের অংশ হিসাবে সেটলারদের পাহাড়ি মেয়েদের বিয়ে করে মুসলমান বানানোয় উৎসাহ দেয়৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর সৌদি এনজিও আল রাবিতা খাদ্য নিরাপত্তা, নগদ অর্থ আর কর্মসংস্থানের প্রতিদান হিসাবে দরিদ্র পাহাড়িদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করছে৷ আদিবাসীদের মধ্যে ইসলামের প্রসারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কাজ করে গেছে৷ তারা পাহাড়িদের গনহত্যা আর ধর্ষণ করেছে, যাতে শান্তিবাহিনীকে সমর্থন না দিতে পারে৷”
এই রাষ্ট্রীয় ধর্ষণ কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে তাই একে সিস্টেম্যাটিক রেপ বলতে হয়৷ একজন অস্ট্রেলীয় গবেষক, জয়টি গেরেচ পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশু ও বালিকাদের যৌন নির্যাতন নিয়ে বলেছেন,
‘‘জুম্ম শিশুদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও বন্দি করা হয়েছিল৷ তাদের বন্দি অবস্থায় নির্যাতন, এমনকি বেয়োনেট দিয়ে বিদ্ধ করে এবং আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল৷ জুম্ম মেয়েদের ‘সিস্টেমেটিক্যালি ধর্ষণ’ করেছিল নিরাপত্তা বাহিনীর সৈন্য এবং অবৈধ বাঙালি সেটলাররা৷”
পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণসহ সকল মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করতে হলে তা বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখেই করতে হবে৷ অফিশিয়ালি পাহাড়ে আর ইনসারজেন্সি নেই, অথচ আর্মির কাউন্টার ইনসারজেন্সি আজও চলমান৷ পাহাড়ি নারীর ধর্ষণকে কাউন্টারইনসারজেন্সি অপারেশনের সুযোগে জায়েজ করা আর ধর্ষকদের ইমপিউনিটি দেওয়া বর্বরতা এবং মানবতাবিরোধি অপরাধ৷ দেশের সকল মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের এই বর্বরতার বিরোধিরা করা দরকার৷
বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ধর্ষণকেই প্রকারান্তরে উৎসাহ দিয়ে চলেছে৷ এর পরিবর্তন চাইলে দেশের শুভবোধ সম্পন্ন সকলকেই তা চাইতে হবে৷ আর না হলে যতবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূনরাবৃত্তি হবে, ইতিহাসের পূনরাবৃত্তির সম্ভাবনা থাকবে৷
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে রাষ্ট্রের নীতিমালায় মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না৷ পার্বত্য চুক্তির ২০ বছর পর আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম কি উর্দিওয়ালাদের নীতিতেই চলবে, নাকি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক নিয়মে চলবে– রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি৷