বিজয় দিবসে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নে আদিবাসীদের তিনটি গ্রামে হামলা হয়৷ এতদিন পর আজও সর্বস্ব খুইয়ে খোলা আকাশের নীচে বাস করছেন পাহাড়ি বাসিন্দারা৷ তাঁদের সহায়তা করার কেউ নেই, নেই নিরাপত্তা৷
হামলার শিকার দোকানি লক্ষ্মীরিতা চাকমা এবং সুরিদাসপাড়া গ্রামের প্রধান রাম কার্বারি, গ্রামবাসী সঞ্জীব চাকমা ও লেহকুমার চাকমা জানান, হঠাত্ হামলার কারণে তাঁদের পক্ষে কোনো কিছু বাঁচানো সম্ভব হয়নি৷ সকাল সাড়ে আটটা থেকে ন’টার দিকে পাঁচ শতাধিক বাঙালি এই হামলা চালায়৷ হামলাকারীরা ঘর-বাড়িতে আগুন, লুটপাট ছাড়াও আনারস খেত, লিচুবাগান ধ্বংস করে৷
‘ভিটেমাটি খুইয়ে আজ আমরা সর্বস্বান্ত, আতঙ্কগ্রস্ত’
হামলার অপর এক শিকার চঞ্চলাদেবী চাকমা বলেন, ‘‘আমার কমপক্ষে ৫০০ আড়তি ধান (এক আড়তিতে ১০ সের) পুড়ে গেছে৷ জমি থেকে নতুন তোলা এই ধান এখনো আমরা খাওয়াই শুরু করিনি৷ এবার কীভাবে আমাদের সংসার চলবে?”
বনবিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমত্ ওগাসা ভিক্ষু জানান, ‘‘হামলাকারীরা মন্দিরে থাকা সাতটি পিতলের বৌদ্ধমূর্তিও নিয়ে গেছে৷ এ সময় মন্দিরঘর, সিমেন্ট এবং কঙ্কর দিয়ে তৈরি বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে৷”
সুরিদাসপাড়ার বরদ চাকমার ছেলে রতন চন্দ্র চাকমা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মোট ৫৬টি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ লুটপাট চালানো হয়েছে ৬২টি ঘরে৷ এছাড়া আনারস, লিচু ও সুগন্ধি আগরের বাগান ধ্বংস করা হয়েছে৷ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে গোলার ধান-চালসহ সবকিছু৷” তিনি বলেন, ‘‘হামলার পর সরকারের তরফ থেকে আমাদের এখনো কোনোরকম নিরপত্তা দেয়া হয়নি৷ দেয়া হয়নি কোনো সহায়তা৷ তাই আমরা নিরপত্তাহীনতায় ভুগছি, আবারো হামলা হতে পারে – এই আতঙ্কে আছি আমরা৷”
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘বাঙালি হামলাকারীরা ‘প্রশাসনের’ সহায়তায় দিনের বেলা এই হামলা চালায়, চালায় নির্যাতন৷ অরুণ চাকমার বৃদ্ধা মাকেও রেহাই দেয়নি তারা৷ তাঁকে বেদম মারপিট করে৷ তাদের উদ্দেশ্য পাহাড়িদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করা৷ কিন্তু এখনো অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ আমরা থানায় মামলা করতেও সাহস পাচ্ছি না৷ তিনটি গ্রামের পাহাড়িরা এখন ভিটেমাটি হারিয়ে এক বিভীষিকাময় জীবনযাপন করছেন৷”
‘পোশাক দেখলেই চেনা যায় হামলার সহায়তাকারীদের’
একই গ্রামের প্রীতিবালা চাকমা ডয়চে ভেলেকে জানন, ‘‘হামলার আগে তাঁদের গ্রামে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়৷ আর সেই গুলি ছোড়ার পরই প্রায় পাঁচশ’ বাঙালি একযোগে তিনটি গ্রামে হামলা চালায়৷ পাহাড়িরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে তাঁদের ওপর নির্যাতন করা হয়৷ দীর্ঘক্ষণ ধরে হামলাকারীরা অগ্নিসংযোগ এবং তাণ্ডব চালায়৷ সে সময় পুলিশ এবং প্রশাসনের লোকজনকে খবর দেয়া হলেও, তাঁরা কেউ আসেননি৷”
কারা গ্রামে হামলা করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘‘তারা’ হামলাকারীদের সহায়তা করেছে গ্রামে ঢুকতে৷ ‘তারা’ সাধারণ মানুষ না৷ ‘তাদের’ নাম বলা যাবে না৷ সবাই ‘তাদের’ দেখেছে৷ ‘তাদের’ পোশাক দেখলেই চেনা যায়৷”
প্রীতিবালা চাকমা জানান, ‘‘হামলায় মোট ১০২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ পুলিশ হামলার পর এসেই আবার চলে যায়৷ নারী-শিশু এবং বৃদ্ধসহ সবাই এখনো খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছেন৷ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা তো দূরের কথা, এখন তারা আবার আমাদের চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে৷”
তাঁর কথায়, ‘‘আমার বাড়ি-ঘর যখন পুড়িয়ে দেয়া হয় তখন আমারা শিশু সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করি৷ ফিরে এসে দেখি সবকিছু ছাই হয়ে গেছে৷”
‘আমরা ত্রাণ, ক্ষতিপূরণ চাই না, চাই নিরাপত্তা’
ঘটনার পর রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার আমেনা বেগম, সেনাবাহিনীর নানিয়ারচর জোনের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সোহেলসহ প্রশাসনের ঊর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন৷ জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন৷ তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ এক লাখ টাকা দেওয়া হয়৷ এছাড়া বাড়ি নির্মাণের জন্য ঢেউটিন, কম্বলসহ ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি৷
কিন্তু আদিবাসী নেতা ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সামান্য সহায়তা বা ত্রাণও গ্রহণ করেননি ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা৷ তাঁরা নিরাপত্তা চেয়েছেন৷ তাঁদের নিরাপত্তা না দেয়া হলে তাঁরা কোনো ধরনের সহায়তা না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন৷”
তিনি বলেন, ‘‘এবার এত বড় হামলা এবং অগ্নিসংযোগের পরও পুলিশ প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না৷ গণমাধ্যমগুলোও কেন জানি নীরব৷ ঢাকায় আদিবাসীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করলেও সুশীল সমাজের প্রতিবাদ লক্ষণীয় নয়৷”
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার কথায়, ‘‘এবারের হামলা নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে৷ প্রশাসনের ইন্ধনেই যে এই হামলা হয়েছে – এমন অভিযোগও রয়েছে৷ তবে যাই হোক এখন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং নিরাপত্তার আশু প্রয়োজন৷” এর সঙ্গে তদন্ত কমিশন গঠন করে হামলাকারীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের আইনের আওতায় আনার দাবিও জানান এই আদিবাসী নেতা৷