গত ১৩ আগষ্ট সড়ক দুঘর্টনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীর সহ পাঁচজন মানিকগঞ্জে এবং আরো পাঁচজন পাবনায় নিহত হয়েছেন। তার মাত্র একদিন আগে ঢাকার উত্তরায় র্যাবের গুলিতেও পাঁচজন নিহত হয়েছিলেন। এই পনেরজন নিহত আদম সন্তানের মধ্যে তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীর ছিলেন অসাধারণ মাপের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, বাকিরা সাধারণ। তারেক মাসুদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো ছাত্রজীবনে তাঁর ‘আদম সূরত’ ডক্যুমেণ্টারীর একটি প্রদর্শনীতে। প্রচার বিমুখ একজন সাদাসিধে মানুষ। আর মিশুক মুনীর তো মৃত্যুর পরই প্রথম ক্যামেরার সামনে এলেন। আসাধারণ হয়েও তাঁরা ছিলেন সাধারণের চেয়েও সাধারণ।
আমাদের মধ্যেকার কিছু অতি উৎসাহী সাধারণ মানুষ তাঁদের আমৃত্যু চর্চিত ‘সাধারণ’ পরিচয়কে ‘অসাধারণ’ করে তুলতে আকাশ-বাতাস-কাগজ-মিডিয়া-ইণ্টারনেট কাঁপিয়ে তুললেন। সেই সাথে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এলেন তাঁদের পরিবার স্বজন। কেউ কেউ তো তাঁদের পরিবার স্বজনের নেতৃত্বে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলার স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে শুরু করে দিলেন। মিডিয়ার সামনে সাহসী বক্তৃতা দিয়ে মিশুক মুনীরের স্ত্রী সেই বিপ্লবের গর্ভধারণ করালেন। ইণ্টারনেট, ইমেইল, ফেসবুকে লগ-ইন করলেই সেই বক্তব্যের ভিডিও লিংক। এবার বুঝি বিপ্লব হয়েই যায়!
সরকারে উপেক্ষিত রাজনৈতিক নেতা হতে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়ে এবং পত্রিকার কলাম লিখে আন্দোলনের ফরমুলা দিতে শুরু করলেন। কেউ আমরণ অনশনে যাবার হুমকী দেন তো কেউ শহীদ মিনারে ঈদের দাওয়াত।
হঠাৎ গর্ভপাত! গত ২৪ আগষ্ট ২০১১ তারিখে রাত্রের সংবাদে দেখা গেল সাধারণ তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের অসাধারণ স্বজনরা তাদের শোক, কষ্ট, বেদনা, ক্রোধ সব কিছু ভুলে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দরবারে গিয়ে হাজির! সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের ‘কাগজের ফুল’ নির্মানের জন্য আর্থিক অনুদানের আশ্বাস দিলেন। মিশুক মুনীরের স্ত্রী এইবার মিডিয়ার সামনে দূর্ঘটনার আলতাফীয় দর্শণ বয়ান করে বিদায় হলেন।
কোন এক অজ্ঞাত সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে প্রায় সবগুলো প্রিণ্ট, ইলেক্ট্রনিক এবং ইণ্টারনেট মিডিয়া এই খবরকে ব্ল্যাক আউট করলো। এর মাজেজা সাধারণদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় নাই। সাধারণরা যা বোঝে তা হচ্ছে সরকারী অনুদান বাণিজ্যে আরেকটি সিনেমা হয়তো তৈরী হবে তবে সেটা তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের ‘কাগজের ফুল’ হবে না। বরং কিছু টাকা সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত সাধারনের পরিবারকে দিলে ওরা উপকৃত হতো।
অসাধারণের মৃত্যু নিয়ে আমরা সাধারণেরা যত হা-হুতাশ বা কান্নাকাটি করি, অসাধারনেরা কি সেগুলোকে কোন পাত্তা দেয়? নাকি সাধারণের মৃত্যুতে তাদের কোন সহানুভূতি জাগে? এইজন্য চলুন সাধারণের মৃত্যুতেই আমরা সাধারণরা হা-হুতাশ করি, কান্নাকাটি করি, প্রতিবাদ করি, বিপ্লব করি।