১৯৭১ সালে তৎকালীন সময় জামায়েত ইসলামের মুখপত্র ছিল দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা। আর এই পত্রিকায় রাজাকার গোলাম আযমের দেয়া বিবৃতি সহ যে সব খবর গুলো প্রকাশ করেছে তার থেকে সংকলিত কিছু বিবৃতি তুল ধরলাম আপনাদের কাছে।
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা-
গো আযমের যুক্ত এক বিবৃতিতে সঙ্গে ছিলেন মওলানা নুরজ্জামান, তিনি একাত্তরের জামায়েত ইসলামীর প্রচার সম্পাদক ছিলেন সাথে ছিল জামায়াতের অন্যতম নেতা গোলাম সারওয়ার সেখানে গোলাম আযম বলে- ‘ভারত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। ভারতীয় বা পাকিস্তান বিরোধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারী যেখানেই যাবে, সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের দেশ প্রেমিকরা তাদের নির্মূল করবে।’
১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল, শুক্রবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
গো আযম মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তনে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে ভারত প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশপ্রেমের মূলে আঘাত হেনেছে। এ ধরনের অনুপ্রবেশ এ প্রদেশের মুসলমানদের কাজেই আসবে না।’
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, শনিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
গোলাম আযম জামায়েত ইসলামীর ছাত্র সংঘের এক বিবৃতিতে বলে, ‘দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীদরে হাত থেকে পূণ্য ভূমি পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ছাত্র সংঘের প্রতিটি কর্মী তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে যাবে। হিন্দুস্তানের ঘৃণ্য চক্রান্তের দাঁতভাঙা জবাব দেবার জন্য ছাত্র সংঘ কর্মীরা সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল, সোমবার,বায়তুল মোকাররম, বাংলাদেশ
বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে থেকে গোলাম আযম নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম মিছিল বের করে। মিছিলে ব্যাবহার করা পোস্টার, ফেস্টুনে লেখা ছিলো “দুষ্কৃতিকারীরা দূর হও” “মুসলিম জাহান এক হও” “পাকিস্তানকে রক্ষা কর”। “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আযম জিন্দাবাদ।”পাকিস্তানের উৎস কি- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ।” “মিথ্যা প্রচার বন্ধ কর। “ব্রাক্ষ্মবাদ নিন্দাবাদ, সাম্রায্যবাদ মূর্দাবাদ” । মিছিলে পাকিস্তানের জন্য মুনাজাতও করেন গোলাম আজম।
১৯৭১ সালের ১৩ মে বৃহস্পতিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
জামায়েত ইসলামী ছাত্র সংঘের এক বিবৃতিতে গো আযম বলে, ‘দেশের বর্তমান দুরবস্থার জন্য ছাত্রসমাজকে দায়ী করা হয়। অথচ ছাত্র সংঘের কর্মীরাই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন ও (পাকিস্তান) সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে বেশি তত্পর। ছাত্র নামধারী ভারতের সাম্রাজ্যবাদের যে সমস্ত চর তথকথিত “বাংলাদেশ”-প্রচারণা চালিয়েছিল তারা ছাত্র সমাজের কলঙ্ক। তাদের জন্য সমুদয় ছাত্র সমাজকে দায়ী করা ঠিক নয়।’
১৯৭১ সালের ১৭ জুন বৃহস্পতিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
জামায়েত ইসলামের ছাত্র সংঘের নেতা গো আযম বিবৃতি দিয়েছিল, ‘দুষ্কৃতিকারীরা এখনও তাদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করা। পূর্ব পাকিস্তানের এমন নিভৃত অঞ্চল রয়েছে যেখানে দুষ্কৃতকারীরা জনগণকে পাকিস্তান রেডিও শুনতে দেয় না।
১৯৭১ সালের ১৯ জুন, শনিবার, লাহোর, পাকিস্তান
রাজাকার গোলাম আযম প্রেসিডেন্ট ইহায়িহা খানের সাথে বৈঠক শেষে বলে, “কেবলমাত্র দেশপ্রেমিক জনগনের সাহায্যে দুষ্কৃতিকারীদের প্রতিহত করা যেতে পারে। এই দেশ প্রেমিক বলতে এ রাজাকার, আল বদর, আস শামস কেই গোলাম আযম বুঝিয়েছে।
১৯৭১ সালের ২০ জুন রবিবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
লাহোরের বিমানবন্দরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখে গোলাম আযম। বক্তব্যে বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে অধিক সংখ্যক অমুসলমানদের সহায়তায় শেখ মুজিবুর রহমানের হয়তো বিচ্ছিন্নতার ইচ্ছা থাকতে পারে। অবশ্য তার ছয় দফা স্বাধীনতাকে সম্ভব করে তুলতে পারত।সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সকল দুষ্কৃতকারীদের উত্খাত করেছে এবং বর্তমানে এমন কোন শক্তি নাই যা সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’
১৯৭১ সালের ২২ জুন মঙ্গলবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
রাজাকার গোলাম আযমের এক সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হয় এই দিনে। সেখানে এই রাজাকার বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা ইসলামকে কখনও পরিত্যাগ করতে পারে না। এ কারণে তারা পাকিস্তানকেও ত্যাগ করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তান ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দুষ্কৃতিকারী ও রাষ্ট্র বিরোধী হিসেবে আখ্যা দেয় এই নরঘাতক।
১৯৭১ সালের ২৩ জুন বুধবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
এই দিনে ছাত্র সংঘের এক কর্মিসভায় গো আযম বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানিরা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদের সাথে একত্রে বাস করবে। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। যেসব দল খোলাখুলিভাবে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন শুরু করেছিল এবং স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য জনতাকে উত্তেজিত করেছিল সেসব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য এই গো আযম সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।’
১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট মঙ্গলবার, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা –
মাদ্রাসার এক শিক্ষা সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, ‘এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, আদর্শিক যুদ্ধ। আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই দেশকে বাঁচিকে রাখার জন্য যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।’
২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইট এর বর্বরোচিত হামলা সম্পর্কে গোলাম আযম বলে, ‘২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা ছিল এদেশের মাটি রক্ষার জন্য।’
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর শুক্রবার, রাওয়াল পিন্ডি, পাকিস্তান-
আলবদর আলশামস শান্তি কমিটির রাজাকারদের প্রশংসা করে এই গোলাম আযম বলে, যদি তাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে দেয়া হয়, তাহলে তারা দুষ্কৃতিকারীদেরকে নিজেরাই খতম করে দিতে পারবে।
১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর শনিবার, রাওয়াল পিন্ডি, পাকিস্তান-
পাকিস্তান সরকারকে গো আযম আশ্বস্ত করে বলে, আমরা দুষ্কৃতিকারী বিচ্ছিন্নবাদীদের বিরুদ্ধে সরকারের সাথে সহযোগিতা করছি।
১৯৭১ সালের ১ লা ডিসেম্বর বুধবার, রাওয়াল পিন্ডি, পাকিস্তান-
গোলাম আযম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে ৭০ মিনিট বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিবাহিনীকে শত্রুবাহিনী আখ্যায়িত করে গোলাম আজম বলেন, “এদেরকে ধ্বংস করার জন্য রাজাকার বাহিনীই যথেষ্ট।”
সূত্রঃ
- মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্র
- মুক্তিযুদ্ধ ই- আর্কাইভ
- দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা