নিখিল চন্দ্র জোয়ারদারকে যারা হত্যা করলো

নিখিল চন্দ্র জোয়ারদারকে যারা হত্যা করলো এবং যারা যারা এই হত্যার আয়োজনে সম্পৃক্ত ছিল- তাদের সবার বিচার করতে হবে। উপরতলার বহুরূপী রাজনীতি ও রাষ্ট্রচরিত্র ব্যাপকভাবে আমাদের সমাজের উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে- এরচেয়ে উদ্বেগের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। কিছুদিন আগে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার হিজলা গ্রামে দু’জন শিক্ষককে শাস্তি দিয়ে জেলখানায় পাঠানো হয়েছে- অভিযোগ ইসলাম অবমাননা ও মহানবীকে কটুক্তি করা। সেদিনকার ঘটনার বিবরণ কিছুটা শুনে ভয়ানক নিঃস্বতা অনুভব করেছি। যার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ আনা হয়েছিল তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। বিজ্ঞানের ক্লাস নেয়ার সময়ে তিনি এমন কিছু বলেছেন যাতে কারো কারো মনে হয়েছে, তার কথায় ধর্মের (ইসলামের) অবমাননা হয়েছে। পাশ্ববর্তী মাদ্রাসার অংশগ্রহণে বিষয়টি নিয়ে বিপুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে- এক পর্যায়ে শত শত মানুষ এসে যুক্ত হয়ে বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

প্রধান শিক্ষক অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচানোর চেষ্টা করলে উপস্থিত মব তার বিরুদ্ধেও রুষে উঠেছে। এক পর্যায়ে মব তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছে। অথচ কেউই ভাল করে জানে না যে ওই শিক্ষক আসলে কী বলেছেন। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া একটা কথার সূত্র ধরে স্কুলের একজন বিজ্ঞানের শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হাজির হয়েছে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ! অন্তত বাগেরহাটের কোথাও এই মানুষ আমি আগে দেখিনি বা শুনিনি।

পুলিশ প্রশাসন এসে তাদের জীবন বাঁচানোর স্বার্থে (ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলাপে তারা এটাই দাবি করেছেন) ওই দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছেন। তাতেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। এক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট তাদের ততক্ষনাত বিচার করেছেন- মব তখনো তাদের ঘেরাও করে রেখেছে। প্রধান শিক্ষকসহ অভিযুক্ত শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে ছয়মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এখানে শেষ হয়ে গেলেও না হয় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যেত- তাদের অন্তত জানে বাঁচানো গেছে। কিন্তু ছয়মাস পর তারা যখন জেল থেকে বের হয়ে বাংলার মাটিতে নিরাপদে বেঁচে থাকবেন- সে সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। একেতো তারা রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত ইসলাম অবমাননাকারী, উপরন্তু তারা দুজনেই হিন্দু। নিরীহ দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার বাঁচতে পারেননি।

ব্যাপারটা এমন নয় যে আমাদের সমাজে আগে থেকেই খুব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান ছিল বা আছে, কিন্তু নূন্যতম সহনশীলতা টুকু ছিল- এটাতো আমরা দেখে এসেছি। যে মানুষেরা শিক্ষককে পিটিয়ে মারতে এসেছে তার বাইরেও অনেক মানুষ আছে, তারা সবাই চুপ হয়ে যাচ্ছে কেন? রাষ্ট্র কী তাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে?

খারাপ রাষ্ট্রচরিত্র কী জিনিস তা প্রতিদিনই আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি। অসত, দূর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারীদের দলের সরকারের চেহারা কেমন হয় এবং সেখানে মানুষ, তার জীবন ও সম্পদের কী পরিণতি দাঁড়ায়- তা আমরা ক্ষণে ক্ষনে টের পাচ্ছি। রাষ্ট্র ও সরকারের এই জঘন্য রূপের সাথে আমরা অনেক আগে থেকেই পরিচিত। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমাদের সমাজ ও মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন কোনো সম্ভাবনার দিন গুনি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল- সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাচ্ছে।

You may also like...

Read previous post:
মরনোত্তর দেহদান

ইয়োরোপে মৃত্যুবরণ করাও এখন অত্যন্ত ব্যয়বহুল ব্যাপার। মারা যাওয়ার পর একটা কফিনের দাম, কবরস্থানে জমির দাম, সমাহিত করার খরচ, সবশেষে...

Close