ধর্মীয় ভণ্ডামির মুখোশ পরে সমাজযন্ত্রের হর্তা কর্তারা আধুনিকতার যুগেও ধর্মীয় গোঁড়ামি আর মৌলবাদের ঝাণ্ডা ধরে দেশের উন্নয়নের পথে তরোয়াল হাতে ঠাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। অনৈতিক আর মৌলবাদের আগ্রাসনে সমকামী সত্ত্বার বিকাশ বাংলাদেশে এখনও প্রায় অসম্ভব। রাষ্ট্রযন্ত্রও সমকামী সত্ত্বাকে অভিশপ্ত মনে করে আইনের শিকলে বেঁধে সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের নাম দিয়েছে। এই সমকামী সত্ত্বাকে আমাদের দেশে স্বীকৃতি দিতে কত যুগ পার করতে হবে, এখনও অজানা।
সমকামিতাকে উন্নত দেশগুলো স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশ সমকামিতাকে অভিশপ্ত এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেই মনে করে। আবার বাংলাদেশের সফিস্টিকেটেড সোসাইটি সমকামিতাকে সামনাসামনি সমর্থন করলেও কোন সমকামী সত্ত্বাকে সামনে দেখে ভদ্রতার খাতিরে কিছু না বললেও আড়ালে এখনও মুখ টিপে হেসে ফেলেন অথবা বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করে বিকৃত বিনোদনের পর্যায়ে নিয়ে যান।
এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশের প্রায় ৯৯.৯৯% মানুষ সমকামিতাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন নি। এই মেনে না নেয়ার অন্যতম কারন হলো আমাদের পারিবারিক শিক্ষা ও সমাজযন্ত্র। কোন শিশু কিভাবে বেড়ে উঠবে তার প্রাথমিক নিয়ন্ত্রন প্রথমে পরিবারের উপরে এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ নিয়ন্ত্রন নির্ভর করে সমাজযন্ত্রের উপরে। আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম- নীতির কারনে পরিবারগুল ছোটবেলা থেকেই ধরেই নেন একজন ছেলে বা একজন মেয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতিই আকৃষ্ট হবে।এটাই স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নিয়ম। যদি কোন ছেলে বা মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাহলে ধরেই নেয়া হয় সে অসুস্থ অথবা মানসিক বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ। সেই মানুষটাকে পরিবার থেকে বিতারির অথবা ত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়। তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির মাঝে। পরিবার থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত করে দেয়া হয়। কোন কোন পরিবার একে রোগের নাম দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। আবার অনেক সমকামী সত্ত্বা তাদের সমকামী হবার বিষয়টি গোপন করে নীরবে নিভৃতেই বাকি জীবনটা একাই কাটিয়ে দেন।
অনেকে সমাজযন্ত্রের অনৈতিক আর ন্যাকারজনক অমানসিক চাপের মুখে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আবার অনেকে আছেন সমকামী সত্ত্বাকে গোপন করে যান শুধু মাত্র এই সমাজযন্ত্রে টিকে থাকার জন্য, এর পরিণাম সরূপ পরিবারগুলো জেনে অথবা না জেনে সমকামী মানুষদের সহজ স্বাভাবিক ভেবে বিয়ে দিয়ে দেয় এবং তাদের জীবনটার সাথে আর এক নিষ্পাপ জীবনও নষ্ট করে দেয়। আমাদের বাংলাদেশ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের পর যদি ছেলের সমকামি সত্ত্বা হবার দরুন বংশ বিস্তার না হয় তাহলে ছেলে সহ ছেলের পরিবার সম্পূর্ণ দোষটি মেয়ের উপরে চাপিয়ে দিয়ে নিষ্পাপ অসহায় মেয়েটিকে শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করে। পরিণাম সরূপ হয় সেই অসহায় নিরাপরাধ মেয়েটি আত্মহত্যা করে না হয় ছেলের পরিবার মেয়েটিকে মেরে ফেলে আবার নতুন করে ছেলের বিয়ে দেয়। তাই সত্য আড়ালেই থেকে যায়।
বাংলাদেশর সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্র যদি সমকামী মানুষগুলোকে মানুষ হিসেবে এই রাষ্ট্র আর সমাজে বসবাসের সুযোগ করে দিত তাহলে অনেক নিরাপরাধ মানুষের জীবন বেঁচে যেত। বাংলাদেশ যদি মানবতাকে সকল ধর্মের উপরে স্থান দিয়ে মানুষই মানুষের জন্য এই বিরল দৃষ্টান্তের স্থাপন করতে পারত তাহলে এই দেশটা বরই সুন্দর হতো। উন্নত দেশগুলতে সমকামী মানুষ যেমন একসাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করতে পারছেন। সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক এবং স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করছেন, পরিবার গঠন করছেন এবং একই সাথে বাবা মায়ের দায়িত্ব পালন করছেন।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত এক দম্পতির একজন হলেন জন, পেশায় একজন ডেপুটি হেড টিচার এবং তার পার্টনার স্টীভেন একজন হিপনোথেরাপিস্ট। দুজনে ২৪ বছর একসাথে আছেন। যুক্তরাজ্য যখন এলজিবিটি সোসাইটির সকলকে বিয়ে করার অনুমতি প্রদান করে আইন পাশ করে তখন এই দম্পতি বিয়ে করেন একে অপরকে। এরপর যুক্তরাজ্য যখন দত্তক আইনের পরিবর্তন করে এলজিবিটি সোসাইটির সকলের জন্য সন্তান দত্তক নেয়ার আইন পাশ করে, তখন এই দম্পতি ২ জন অনাথ বাচ্চাকে দত্তক হিসেবে নেন। মা, বাবা দুজনের ভালবাসা দিয়ে বড় করে মানুষের মতো মানুষ করতে চান জন এবং স্টীভেন। অত্যন্ত সুন্দর ভাবে মানুষ করেও যাচ্ছেন এই দম্পতি।
অপরদিকে বাংলাদেশে সমকামীদেরকে মেরে ফেলা হচ্ছে, পরিবার থেকে বিতাড়িত ঘোষণা করে ত্যাজ্য করা হচ্ছে, হয় সমকামী যুগলদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হচ্ছে অথবা এরা দেশান্তরী হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। ভেবে দেখুন, এই সমকামী স্বত্বাদেরকে যদি রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সমাজযন্ত্র একটু সুস্থ, স্বাভাবিক, স্বাধীন জীবন যাপন করার অনুমতি প্রদান করতেন তাহলে এরা আমার আপনার মতোই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারতেন। কাউকেই কারো জন্য বিনা দোষে মরতে হতো না। আমাদের দেশে তো অনেক অনাথ আস্রম অথবা এতিমখানা রয়েছে। ভেবে দেখুন, সমকামী মানুষেরা বিয়ে করে আমার অথবা আপনার মতো পরিবার গঠন করতে পারতেন। এতিম খানা থেকে বাচ্চাদের দত্তক নিয়ে এদেরকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারতেন। এতিম বাচ্চাগুলো পেত তাদের বাবা অথবা মাকে। অসহায় বাচ্চাগুলো পরিবারের অভাবে অবহেলা আর অযত্নে লালিত পালিত হতো না। কেউ পেত বাবা, মায়ের নিঃস্বার্থ অতুলনীয় ভালবাসা আর যত্ন, আবার কেউ পেত সন্তান লাভের ও লালনের পরম স্বর্গীয় অনন্দ।
আমাদের একটু চেষ্টা, স্বদিচ্ছা আর মানসিক পরিবর্তনই পারে এক অনাথকে একটি পরিবার দিতে, আবার কাউকে দিতে বেঁচে থাকার সুযোগ। সময় হয়েছে পরিবর্তনের। ১৪০০ বছরের পুরনো ধর্মীয় গোঁড়ামি আর মৌলবাদী সত্ত্বাকে উপড়ে ফেলে আমরাই পারি মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখতে। মানুষই মানুষের জন্য। মানব ধর্মের উপরের আর কোনই ধর্ম নাই। নিজের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলুন। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ খুন করে এই অধর্ম করা বন্ধ করুণ। সমকামীদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করুণ। বছর বছর যদি আপনার ব্যবহার করা অতি প্রিয় মোবাইল, জামাকাপড়, আর প্রতিদিন ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করতে পারেন তাহলে মনুষ্যত্বের জন্যে ১৪০০ বছরের পুরনো ধর্মীয় গোঁড়ামি আর মৌলবাদী ভাবনা পরিবর্তন করতে পারবেন না?