শিরোনাম দেখে আপনাদের অনেকেই ভাবছেন আমি হয়তো পশ্চিমা চার্চগুলোর যাজকদের দ্বারা শিশু নির্যাতনের কথা বলছি। আসলে তা নয়। আমি এখানে বোঝাচ্ছি শিশুকে মানসিকভাবে পরিণত হওয়ার আগেই একটি ধর্মীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়াও এক প্রকারের শিশু নির্যাতন। আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন চার্চে শিশুদের উপর যাজকদের চালানো যৌন নির্যাতনের ভয়াল কাহিনী আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। পাশের দেশ ভারতেও ফাঁস হয়ে গেছে প্রভাবশালী ধর্মগুরু নিত্যানন্দের যৌন কেলেঙ্কারির কথা। আমাদের দেশেও মাদ্রাসায় হুজুর কর্তৃক ছাত্র-ছাত্রীদের যৌন নির্যাতিত হওয়ার ঘটনার খবর কদিন পরপরই পত্রপত্রিকায় আসে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় পাপের ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে এসব শিশুদের ঘটনা চেপে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কখনো আবার হুজুর নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন এভাবে, “আমার উপর শয়তান ভর করেছিল। এতে আমার কি দোষ”। আমরা পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টকেও দেখেছি ভ্যাটিকানের যাজক, কার্ডিনালদের কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার জন্য ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে। তারা এমমও দাবি করেছে যে শিশুরাই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পছন্দ করে। নির্যাতনকারী নরপশুরা ভালভাবেই জানে, শিশুদের মনে এই ভয় কতটা প্রবলভাবে কাজ করে। এমন ঘটনা ওই শিশুদেরকে মানসিকভাবে যে আঘাত হানে, সে আঘাত অনেক ক্ষেত্রে তারা সারা জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারে না। একইভাবে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল কোন শিশুর মস্তিষ্কে, কোন কিছু বোঝার মত বয়স হওয়ার আগেই কোন ধারণা বা বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়াটাও কিন্তু শিশুদের জন্য কম ক্ষতিকর নয়।
কারও ধ্যান-ধারণাকে নিজের সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার যে কারও নেই সেটা লেবাননের বিখ্যাত কবি কাহলিল জিবরান তার ‘On Children’ কবিতায়ও উল্লেখ করেছেন,
Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Lives’
Longing for itself.
They come through you but not for you,
And though they are with you yet they belong not to you.
You may give them your love but not your thoughts,
For they have their own thoughts.
You may house their bodies but not their souls,
For their souls dwell in the house of tomorrow, which
You cannot visit, not even in your dreams.
You may strive to be like them, but seek not
To make them like you.
For life goes not backward not tarries with yesterday.
ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা যেখানে তাদের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শিশুদের অধিকার রক্ষায়, সেখানে আমরা দেখতে পাই, ধর্মীয় প্রভাবের কারণে বিভিন্নভাবে সারা বিশ্বেই শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। যখন ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে বিভিন্ন প্রকার ধর্মাচারণে বাধ্য করানোর মাধ্যমেই এই ধরণের নির্যাতন শুরু হইয়ে যায়। ধর্মানুষ্ঠান, ধর্ম প্রচার, ধর্মীয় পুস্তকাদির মাধ্যমে সব ধর্মেই চেষ্টা চালানো হয়, কিভাবে ছোট থাকতেই শিশুদের দিয়ে নিয়মিত ধর্মচর্চা চালানো যায়। মস্তিস্কে শুরুতেই এমন বেড়ি পড়িয়ে দেয়ার পরিনতি এতটাই ভয়ানক হতে পারে যে, মানুষ বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিপূর্ণ নিয়মনীতি দেখলেও অনেক সময় নিজের পূর্ববর্তী ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণা এভাবেই তাদের মাথায় তখন জাঁকিয়ে বসে। শিশুরা তাদের পিতামাতা, আপনজনদের কাছ থেকে যা শোনে তাই বিশ্বাস করে। ঈশ্বর ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন, যীশু ঈশ্বরের পুত্র, যীশু পানির উপর হাঁটতে পারতেন, যীশু মৃত্যুর তিন দিন পর আবার বেঁচে উঠেছিলেন, রামায়ন-মহাভারত হল প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, গীতা হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাক্য, দশাবতারচরিত, জন্মান্তরবাদ (মৃত্যুর পর কর্মফল অনুযায়ী আবার জন্ম হওয়া), কোরান আল্লাহর বাণী, নবী মুহাম্মদের উপর কোরান নাজেল হয়েছিল, নবীর আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি; বলা যায় বড়রা নিজেরা যেটাই বিশ্বাস করে সেটাকেই শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দিতে না পারলে শান্তি পায় না। প্রাপ্তবয়স্করা তখন নিজেদের জাতি, বর্ণ, গোত্র বা ধর্ম রক্ষার নামে শিশুদেরকে যুদ্ধের ময়দানে সহজেই টেনে আনতে পারে। আল কায়েদা তাদের বাহিনীতে শিশুদের আকৃষ্ট করানোর জন্য এখন জিহাদি কার্টুন পর্যন্ত প্রচার শুরু করেছে। শুধু ২০০৪ সালেই সারা বিশ্বে প্রায় ৩ লক্ষ শিশু বিভিন্ন বাহিনীতে যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শিশুদের ব্যবহার যখন ধর্মের নামে করা হয় তখন জাতিসংঘ, এর অঙ্গ সংগঠন ও প্রায় সকল দেশের সরকারই নিশ্চুপ হয়ে থাকে।
র্মীয় শিক্ষা যে আরেকটি ক্ষেত্রে শিশু নির্যাতন নিয়ে আসে সেটা হল লিঙ্গ বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে যা, ছেলে ও মেয়েদের অধিকারের মধ্যে অসমতা তৈরি করে। জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো কিভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারী শিক্ষার প্রসারের কথা ভাবতে পারে যেখানে মেয়েশিশুদের ঘরের বাইরেই যেতে দেয়া হয় না। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের তালিবান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মেয়েদের স্কুলে নিয়মিতই বোমা হামলা চালানো হয়। কখনো বা ছড়িয়ে দেয়া হয় বিষাক্ত গ্যাস, যাতে পিতামাতারাও মেয়ে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহ হারায়। একথা মানতে অনেকেই নারাজ যে ধর্মগুলো তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের প্রচার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। হোক সেটা পশ্চিমের সানডে স্কুল বা আমাদের দেশের মক্তব, মাদ্রাসা। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় মাদ্রাসায় পুলিশ রেড করলেই পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন রকম দেশীয় অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। জেএমবির মত জঙ্গি সংগঠনগুলো মাদ্রাসাগুলোকেই বেছে নিয়েছিল তাদের ট্রেনিং ক্যাম্প হিসেবে। তাই মাদ্রাসার প্রতিশব্দই হয়ে গিয়েছিল ‘জঙ্গি তৈরির কারখানা’। এখন কোন শিশুকে যদি শিশুকালেই পাঠিয়ে দেয়া হয় কোন মাদ্রাসায় তবে মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার মানসিকতা কেমন হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।
কোন কাজটি ভাল আর কোন কাজটি মন্দ, একটা শিশুকে এমনটা শেখানো খুব কঠিন কোন কাজ নয়। আর মন্দ কাজটি কেন মন্দ এটাও বুঝিয়ে বললে একটা শিশুর মন খুব সহজেই তা গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ অন্যের কোন জিনিস তার অজান্তেই নিয়ে আসা বা চুরি করা কেন খারাপ কাজ এবং এমনটা করা কেন উচিত না তা খুব সহজেই একটি শিশুকে বুঝিয়ে বলা যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তে শিশুকে যদি শুধু এমন শিক্ষা দেয়া হয়, “খবরদার, চুরি করবি না। তাইলে আল্লাহপাক গুনাহ দিবে” বা “চুরি করলে মৃত্যুর পর দোযখে গিয়ে আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হতে হবে” তাহলে ওই শিশুর মানসিক অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে। সেই সাথে চুরি করাটা কেন একটি খারাপ কাজ বা কেন এ ধরণের কাজ করা উচিত নয় তা সম্পর্কেও কিন্তু শিশুটি অজ্ঞই থেকে যাচ্ছে। একটা শিশুর মনের বিকাশ হওয়ার আগেই নরক বা দোযখের মত ভয়ঙ্কর একটি বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? তাছাড়া নরক, জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে কারও নৈতিকতার উন্নতি সাধন করা সম্ভব নয়। “এরকম কাজ কোরো না, কেউ একজন তোমাকে দেখছে। তোমাকে পরে শাস্তি পেতে হবে”, এটা নৈতিকতা শেখানোর কোন গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হতে পারে না। একবার ভেবে দেখেছেন কি? বুদ্ধধর্মে তো স্বর্গ-নরক, বেহেশত-দোযখ বলে কিছু নেই। তাহলে তারা তাদের শিশুদের কিসের ভয় দিখিয়ে খারাপ কাজ হতে বিরত রাখে? শিশুকাল থেকেই যখন ভয়ের মধ্য দিয়ে কোন শিশু বড় হতে থাকে, সে আর দশজন সাধারণ শিশুর মত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। আমরা কয়েক বছর আগে পাঁচ কি ছয় বছরের শিশু ফাহাদের ঘটনা দেখেছিলাম। এক মাদ্রাসা শিক্ষক ‘কবরের আযাব’ শীর্ষক একটি ভিডিও ফাহাদকে দেখিয়েছিল। যেখানে দেখানো হয় মৃত্যুর পর আত্মাকে কতটা ভয়ঙ্কর উপায়ে শাস্তি দেয়া হয়। ওই ভিডিওটি দেখার পর ফাহাদ তার মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। ভিডিওটিতে ভয়ঙ্করভাবে চিত্রায়িত অত্যন্ত ভায়োলেন্ট দৃশ্যগুলি তাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। তার সমবয়সী খেলার সাথীরা যখন মাঠে খেলত, তখন সে নিজের বাসাতেই বসে থাকত। অসহায় বাবা-মারও তখন আর কিছুই করার ছিল না। তারা নিজেরাই যে নিজেদের সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠানোর মাধ্যমে এমন বিভীষিকাময় পরিনতির দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রিচার্ড ডকিন্সের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠির মাধ্যমে আমরা আরও একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিলার কাহিনী জানতে পারি। যিনি বড় হয়েছিলেন একটি রোমান ক্যাথলিক পরিবারে, আর সাত বছর বয়সেই এক যাজকের লালসার শিকার হয়েছিলেন। তার কাছ থেকে জানা যায় ওই তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন তার জীবনে বিভিন্ন সময়ই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তেমনি আরও একটি ঘটনা তাকে শিশুকালে আরও বেশি আঘাত করেছিল। ছোটবেলাতেই তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি মারা যায়। বন্ধু হারানোর বেদনা তাকে যতটা ব্যাথিত করেছিল তার চেয়েও বেশি বেদনাদায়ক ছিল তখন, যখন সে জানল তার বন্ধুটিকে যেতে হয়েছে নরকের অগ্নিকুন্ডে। কারণ সে ক্যাথলিক ছিল না। তার ভাষায়, “প্রায়ই রাতে দুঃস্বপ্ন হয়ে এটা আমার কাছে আসত, ভাবতে খুব কষ্ট হত যে আমার অত্যন্ত কাছের মানুষদের নরকে যেতে হচ্ছে”। একবার ভাবুন তো, কোন মা তার সন্তানকে বলছে, “বাবা, তোমার সেলিম চাচা খুব ধার্মিক ছিলেন। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, নিয়মিত রোজা রাখতেন। বেশ কয়েকবার হজ্ব করে এসেছেন। উনি মারা যাওয়ার পর আল্লাহ উনাকে সোজা বেহেশতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তোমার হালিম চাচা বেনামাজি ছিলেন। তিনি রোজাও ঠিকমত রাখতেন না। তাই উনি মারা যাওয়ার পর তাকে দোযখে যেতে হয়েছে”। এমন কথা শোনার পর শিশুটির মনের অবস্থা কিরূপ হতে পারে তা আপনিই অনুমান করুন। বিশেষ করে শিশুটি সেলিম চাচা অপেক্ষা তার হালিম চাচাকেই যদি বেশি পছন্দ করে তখন?
শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদান নিয়ে যত অনাকাঙ্খিত সব ঘটনা ঘটে থাকে সেগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। যেহেতু ধর্ম এগুলোর সাথে লেগে আছে তাই এই ধরণের অনাচার নিয়ে কেউই নিজের মুখ খুলতে চায় না। শিশুদের শৈশবের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে ধর্ম তাদের কতটা ক্ষতিসাধন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কেটি পেরি ছোটবেলার কথা স্মৃতিচারণ করে একবার বলেছিলেন,“ধার্মিক ও রক্ষণশীল ক্যাথলিক পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে যে বয়সে আমার ডিজনি বা হ্যান্স অ্যান্ডারসনের ফেইরি টেল পড়ার কথা ছিল, সেই সময়টার পুরোটাই আমার পরিবার নষ্ট করিয়েছে আমাকে দিয়ে বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মীয় পুস্তক পড়ানোর মাধ্যমে”।
এমন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি জীবনের পরবর্তী সময়ে অনেকেরই হয়েছে। শারীরিক শিক্ষাবিদ টিনা ব্রুস এ প্রসঙ্গে বলেন,
“আপনি যদি আপনার শিশুর মাথায় ধর্মীয় কুসংস্কার প্রবেশ না করান তবে প্রকৃত জ্ঞান রাখার জন্য অনেকখানি জায়গা পাওয়া যায়”।
মানসিক নির্যাতনের সাথে ধর্ম শিশুদের শারীরিক নির্যাতনকেও উৎসাহ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রথমেই যে উদাহরণটি আসে সেটি হল ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের Genital Mutilation বা Circumcision বা খৎনা প্রথা। ধর্মগুলো চায় শুধু মানসিকভাবে নয়, বরং শারীরিকভাবেও নিজের অনুসারীদেরকে ধর্মীয় চিহ্ন বহন করতে হবে। কোন শিশুর শরীরের সংবেদনশীলতম অঙ্গে ছুরি চালানোকে একটি সভ্য সমাজ কিভাবে গ্রহন করে তা বুঝতে পারা আসলেই কষ্টসাপেক্ষ। কিন্তু ধর্মীয় নির্দেশ বলে কথা। এই বীভৎস প্রথাটির শিকার কিন্তু শুধু ছেলে শিশুরাই হয় না। সোমালিয়া, সুদান, গিনি, চাদসহ আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম দেশে আজও মেয়েশিশুদের উপর ধর্মের নামে এমন নারকীয় নির্যাতন চালানো হয়। ধর্মীয় নির্দেশ যত বর্বরই হোক না কেন, এটাকে গ্রহণযোগ্যভাবে উপস্থাপন করার জন্য, এটাকে শরীরের জন্য উপকারী দাবি করে ধর্মবাদীরা এই বীভৎস প্রথাটির পিছনেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অপব্যাখ্যা নিয়ে আসে। এখানে একটি প্রশ্ন তোলা যায়। শরীর-স্বাস্থ্যের উন্নতির উদ্দেশ্যে জন্মের পর যদি এই ধরণের অঙ্গহানি ঘটাতেই হয়, ঈশ্বর তবে কি মানুষের শরীরকে যথেষ্ট নিখুঁত করে ডিজাইন করেন নি? নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ ধর্মের অনুসারীদের যাতে আলাদা করতে সুবিধা হয় সেরকম দূরদর্শী চিন্তা মাথায় রেখেই এই ধরণের অঙ্গহানির নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন?
ধর্মগুলো মানুষকে শিশুকালেই এমন শিক্ষা দিয়ে দেয় যে তার ধর্মই একমাত্র সত্য। একমাত্র তার ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারীরাই মৃত্যুর পর স্বর্গে বা বেহেশতে পৌঁছতে পারবে। বাকি সবার স্থান হবে জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে। সে এবং তার ধর্মের জাতভাইরা প্রকৃষ্ট, বাকিরা সবাই নিকৃষ্ট। শুরু থেকেই অন্যদের প্রতি এমন ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়াই ধর্মের বৈশিষ্ট্য। আমরা কি পারি না শিশুদের অন্যদেরকে ভালবাসতে শেখাতে বা মানুষ-মানুষের মধ্যে বৈষম্য না করতে?
আমরা শিশুবিবাহের (বাল্যবিবাহ) বিরুদ্ধে অবস্থান নেই, কারণ বিবাহের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হতে হয়। আবার আমরা শিশুদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডেও (যেমন নির্বাচন) অংশ নিতে দিই না, কারণ ভোট দেয়া বা নির্বাচনে অংশ নেয়ার মত পরিপক্বতা তাদের মধ্যে আসে নি। আমাদের এখন সময় এসেছে শিশুদের বলপূর্বক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদান বিষয়ে বিতর্কে দাঁড়ানোর। অনেকেই হয়তো বলবেন যে, এটা পিতামাতার উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। কিন্তু, ধর্মীয় শিক্ষার কারণে উদ্ভুত শিশু নির্যাতনের বিষয়টি আমাদের চিন্তার উদ্রেক করে, সমাজে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দেয়ার জন্য ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানটির আদৌ কোন প্রয়োজন বা উপযোগিতা আছে কি? এর ফলে যে একটি বিতর্কিত পরিস্থিতির উদ্ভব হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। স্রেফ ‘স্পর্শকাতর’ বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এবং সাধারণ মানুষের এক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলে বা এই বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে চলবে না। সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিশুদের অধিকার রক্ষায় অবশ্যই রক্ষণশীলতার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে হবে। কিন্তু বাস্তবমুখী হলে আমরা দেখতে পারি আশা করা যত কঠিন আশার বাস্তবায়ন করাটা আরও অনেক বেশি কঠিন। তবে আমি স্বপ্ন দেখি যে একদিন সমাজের মানুষ জনগুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন হবে। আরও বেশি চিন্তা করার ক্ষমতা তাদের মধ্যে আসবে।
ততদিনে হয়তো সারা বিশ্বের কোটি শিশুকে ধর্মের নামে নির্মম নির্যাতন নীরবে, নিভৃতে সহ্য করে যেতে হবে।
সহায়ক গ্রন্থপুঞ্জিঃ
Religion’s Real Child Abuse – Richard Dawkins
Religion and Child Abuse -Innaiah Narisetti (Council for Secular Humanism)
Religious Indoctrination is Child Abuse (http://mwillett.org/atheism/.htm )