রাশেদ খান মেনন হজ্জে যাচ্ছেন। শুধু তিনি একাই নন, হাসানুল হক ইনুও হজ্জে যাচ্ছেন। দুজনেই আবার তাঁদের স্ত্রীদেরকেও সঙ্গে নিচ্ছেন। এই পূ্ণ্য কাজে স্ত্রীরা বাদ থাকবেন, তাতো হয় না। বামপন্থীরা আজীবন বামপন্থী থাকেন না। কেউ কেউ মজা করে বলে যে, মানুষ বামপন্থী থাকে ওই তারুণ্যের সময়টাতেই, যখন বাপের হোটেলেই খাওয়া-দাওয়া চলে। এই সময় চাওয়া-পাওয়ার কিছু থাকে না। সংসারধর্ম শুরু করলেই বামপন্থা সুবিধাবাদীসর্বস্ব ডানপন্থার দিকে বাঁক নিতে শুরু করে। একারণেই দেখা যায় ছাত্রজীবনে যারা শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়, পুঁজিপতিদের মুণ্ডুপাত করে, তারাই ছাত্রজীবন শেষে বেছে নেয় এনজিওর বিলাসবহুল চাকুরি। রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু, দুজনেই সুবিধাপন্থার পথে হাঁটছেন বহুদিন ধরেই। এ নিয়ে খুব একটা বিস্মিত নই আমি। আমার বিস্ময় ওই হজ্জে যাওয়া নিয়ে।
এঁরা দুজনেই এখন পর্যন্ত দুটি বাম সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতা। অর্থাৎ অফিসিয়ালি তাঁরা বামপন্থাকে ত্যাগ করেন নি। বামপন্থীরা যে একেবারেই ধর্ম-কর্ম করেন না, বা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন না, এমন নয়। আমাদের দেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনেকক্ষেত্রেই সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে মিশে গেছে বা নিজেই সামাজিক রূপ ধারণ করেছে। ধার্মিক না হয়েও বাধ্য হয়ে এ সমস্তগুলোতে বামপন্থী বা নাস্তিকদের অংশ নিতে হয় সামাজিক চাপে পড়ে। এর মধ্যে পড়ে মিলাদ, কুলখানি, ইদ, জুম্মার নামাজ, এই সব।
কিন্তু, হজ্জ ঠিক এই মাপের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এটি একটি উঁচুমার্গের বিশুদ্ধ ধর্মীয় রিচুয়াল। গভীরভাবে বিশ্বাসী ব্যক্তির পক্ষেই শুধুমাত্র হজ্জে যাওয়া সম্ভব। অনেকে অবশ্য রাজনৈতিক কারণেও হজ্জে যায়। আমাদের সমাজে ভোটের রাজনীতিতে হজ্জফেরত রাজনীতিবিদের আলাদা কদর আছে বলেই হয় তো হজ্জযাত্রা করে থাকেন তাঁরা। তবে, এটা ঠিক যে, যাঁরা হজ্জে যান, তাঁরা মূলত বিশ্বাসী। কেউ হয়তো ধর্মচর্চা একটু কম করেন, কেউ হয়তো একটু বেশি করেন। কিন্তু, চুড়ান্ত সত্যি হচ্ছে যে, তাঁরা সকলেই ধর্মবিশাসে প্রবলভাবে বিশ্বাসীই। রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু ধর্মের এই রাজনীতি না করেও সংসদ সদস্য হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। হজ্জে না গেলে এই অবস্থান সহসাই ক্ষুণ্ণ হবে, এমনও নয়।
তাহলে, কেনো তাঁদের এই হজ্জযাত্রা? বাংলাদেশ কি আসলেই একটা ধর্মভিত্তির রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছে? রাষ্ট্রের কর্ণধার থেকে শুরু করে একেবারে হীন দরিদ্র নাগরিককেও এখন ধর্মের আফিমে বুদ হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের সমাজ যে প্রগতিশীল একটা অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে ধর্মাশ্রয়ী অবস্থানে সরে যাচ্ছে, সেটা গত কয়েক দশক ধরে যাঁরা বাংলাদেশকে লক্ষ্য করছেন, তাঁরা সবাই জানেন।
বাংলাদেশে এখন ধর্মকর্মচর্চা প্রবল। এর ছাপ পড়েছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে। আগে ঢাকার রাস্তায় বয়ষ্ক কিছু নারী আর খুব ধর্মীয় পরিবেশ থেকে উঠে আসা মেয়েরাই শুধু বোরকা পরতো। আর এখন ঘরে ঘরে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল নির্বিশেষে নারীরা হিজাব পরছে। স্কুল-কলেজের বাচ্চা মেয়েগুলোও নিস্তার পায় নি এই পর্দা-পুশিদার হাত থেকে।মাত্র দুই দশক আগেও এই রীতি ছিলো না। এখন জেএসসি বলুন, এসএসসি বলুন, কিংবা এইচএসসি বলুন, মেয়েদের ছবি যখন পত্রিকায় ছাপা হয়, তখন দেখি বিপুলসংখ্যক মেয়ে হিজাব পরে দাঁড়িয়ে আছে। পোশাক যার যার ব্যক্তিগত পছন্দ। এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছি না আমি। কিন্তু, পোশাক দিয়ে একজন মানুষের মন-মানসিকতা অনেকখানি বুঝে ফেলা সম্ভব।
আগে হজ্জে যেতো মূলত বয়ষ্ক লোকেরা। এখন ছেলে-বুড়ো সবার মধ্যেই হজ্জে যাবার হিড়িক চেপেছে। সমাজ নিত্যদিন বদলায়, এতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের বদলে যাওয়াটা এতোটাই দ্রুত এবং অপ্রত্যাশিত যে, এটি হয়ে পড়েছে রীতিমত বিস্ময়কর এবং ব্যাখ্যাতীত।
পাকিস্তানের ধর্মাশ্রয়ী প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধকারে ঢাকা মধ্যযুগীয় পথের বিপরীতে বাঙালি বেছে নিয়েছিলো প্রগতিশীলতা এবং আধুনিকতার এক উজ্জ্বল পথ। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকে বাতিল ঘোষণা করে বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য।পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বাঙালি যে প্রগতিশীলতা, যে মুক্তমনসমৃদ্ধ আচরণ, যে অসাম্প্রদায়িকতা, যে আধুনিকতা দেখিয়েছিলো, সেই মানের ধারে কাছে যাবার মতো যোগ্যতা এখন আর তার নেই।
পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতে। মজার বিষয় হচ্ছে যে, পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানের অবদানই ছিলো সবচেয়ে বেশি। এই রাষ্ট্র গঠনের পরে বাঙালি মুসলমানদের আরো বেশি পরিমাণে গোঁড়া মুসলমান হবার কথা। কিন্তু, বিস্ময়করভাবে স্বাভাবিকতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে বাঙালি মুসলমান হেঁটেছিলো অস্বাভাবিক পথে, একেবারে উল্টোরথের যাত্রা। ধর্মীয় পরিচয় ঝেড়ে ফেলে ধর্মনিরপেক্ষ আবরন গায়ে জড়ানোর জন্য প্রবল ইচ্ছুক হয়ে উঠেছিলো সে। বাঙালি মুসলমানের চিন্তা এবং মননে আধুনিকতা এসে ভর করেছিলো মায়াবী যাঁদু নিয়ে। বাঙালি মুসলমানের এই জাগরণ নজর এড়ায় নি অনেকেরই, নজর এড়ায় নি প্রতিবেশী দেশের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদেরও।
১৯৬০ সালে নহণ্যতে খ্যাত সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবীর সম্পাদনায় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় পূর্বপাকিস্তানের প্রবন্ধ সংগ্রহ।এর প্রকাশক ছিলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ। এতে স্থান পেয়েছিলো মুহাম্মদ আবদুল হাই, বদরুদ্দীন উমর, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কাজঈ মোতাহার হসেন, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহদের মতো বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের লেখা।এই সংকলনের দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় ১৯৬৪ সালে। এতে ভূমিকা লিখেছিলেন দুজন। মৈত্রেয়ী দেবী নিজে এবং অন্নদাশঙ্কর রায়।
ভারত ভাগ হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতে। ধর্মীয় উন্মাদনাই ছিলো পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনের মূল উপাদান। এই উন্মাদনায় বাঙালি মুসলমান ক্ষণিকের উত্তেজনায় অংশ নিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু খুব অল্প দিনের মধ্যেই তার নিজের ঠিকানা খুঁজে নিতে ভুল করে নি। যতই ধর্মের তাওয়ায় দুই পক্ষকে একসাথে ভাজা হোক না কেনো, বাঙালি মুসলমান ঠিকই টের পেয়ে গিয়েছিলো যে জাতিতে সে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানের রুক্ষ্ণ-কঠিন পাথুরে ভূমি তার অন্তরে কোনো আবেদন সৃষ্টি করে না, বরং বাংলা জল, মাটি, জলাভূমিই তাকে টেনেছে আকুল করে। অন্নদাশংকর লিখেছেন,
“ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির মোহ যদিও কারো কারো মন জুড়ে রয়েছে তবু তার সেই একছত্র দাপট আর নেই। দেশভিত্তিক ভাষাভিত্তিক লোকভিত্তিক সংস্কৃতির দিকেও সাধারণের দৃষ্টি পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সব চেয়ে জনপ্রিয় পালার নাম ‘রূপবান’। রেকর্ডে ও ফিল্মে ওর সমকক্ষ নেই। অথচ ওর কথাবস্তু আরব পারস্য থেকে আসেনি, আসেনি উর্দু থেকে। ওটা মুঘল দরবারেরও কিসসা নয়।আমাদেরই চিরপরিচিত ‘মালঞ্চমালা’। শুনলুম ‘ঠাকুমা’র ঝুলি’র সব কটা কাহিনীই রূপান্তরিত হয়ে গেছে। রেডিও পাকিস্তানেও আমরা এন্তার লোকগীতি শুনতে পাই। সবই পূব বাংলার মাটির ফসল।”
এই যে পূর্ব বাংলার মানুষের নিজের মাটির প্রতি, নিজের ঐতিহ্যের প্রতি, নিজের শিঁকড়ের প্রতি, নিজের ভাষার প্রতি, নিজের সংস্কৃতি প্রতি অফুরন্ত টান, এই টানই তাদের চিন্তাধারায় চেতনাগত পরিবর্তন এনে দিচ্ছে ব্যাপকগতভাবে। এই পরিবর্তন এমনই ভিন্ন মাত্রার এবং গুণগতভাবে পার্থক্যসূচক যে অন্নদাশঙ্কর একে তুলনা করছেন রেঁনেসাসের সাথে। তিনি বলেন,
“পূর্ব পাকিস্তানে এই যে ব্যাপারটা চলেছে এটাও একপ্রকার রেনেসাঁস। এর থেকেই আসবে একপ্রকার রেফরমেশন। ইসলামের তথা ইসলামী শাস্ত্রাদির পুনর্মূল্যায়ন। ওই স্টেজটা এখনো আসেনি, তবে এর ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে কোরান শরিফের তর্জমা দিয়ে। যেমন জার্মানীতে হয়েছিল বাইবেলের অনুবাদ দিয়ে। পবিত্র ভাষা আরবী সন্মন্ধে মোহভঙ্গ হয়েছে। বাংলার উপর টান এখন তার চেয়েও বেশী। লোকে বাংলার জন্য জান দিতে পেরেছে ও পারে। আরবীর জন্যে একটি মানুষও মৃত্যুবরণ করবে না।“
পাকিস্তান সৃষ্টির সময়ে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে বাংলা। দুটো ভিন্ন ধর্মের লোক বাস করতো এই ভূখণ্ডে। এদের মধ্যে সবসময় যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দের সম্পর্ক বিরাজ করেছে, এমন নয়। কিন্তু, দুই সম্প্রদায় সন্দেহ, অবিশ্বাস, দ্বিধা-সংকোচ নিয়েও পাশাপাশি থেকে গিয়েছে বড় ধরনের কোনো ঝামেলা ছাড়াই। দেশ বিভাগের সময়ে প্রথম বাংলার হিন্দু এবং মুসলিম অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে গেলো পরষ্পরের মুখোমুখি। দাঙ্গা হচ্ছে, একের হাতে রক্ত ঝরছে অন্যের। যেনো একই বাঙালি জাতি নয়, একই মাটির সন্তান নয়, দু’টো পরষ্পর ঘৃণাকারী জাতিগোষ্ঠী মুখোমুখি হয়েছে একে অন্যকে নিপাত করার উদ্দেশ্যে। পূর্ব বাংলায় মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার সুবাদে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় এক তরফা বিজয়ী হয়েছে মুসলমানেরা। পরাজিত হিন্দুরা দলে দলে দেশ ত্যাগ করেছে।
এই ঘটনাগুলো হৃদয়বিদারক নিঃসন্দেহে। কিন্তু, এগুলোর মাত্রা যতখানি না ভয়াবহ ছিলো, লোকমুখে সেগুলো ছড়িয়েছে আরো বেশি ভয়াবহরূপে। পুর্ব বাংলা মানে মুসলিম দানবদের বসবাস, ছুরি-তলোয়ার হাতেই তাদের ঘোরাফেরা, হিন্দু পেলেই গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করে, হিন্দু মেয়েদের দেখলেই ধর্ষণে উন্মত্ত হয়, এমন একটা ধারণা গ্রথিত হয়ে যায় পশ্চিম বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। মুসলমানদের সবাই যে বিকারগ্রস্থ নয়, সেখানেও যে মানবিক মানুষ আছে, আছে গোঁড়ামিমুক্ত প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক মানুষজন, সেটিকে বিবেচনায় নেবার মতো অবকাশ তাদের ছিলো না। তবে, এর মধ্যেও কেউ কেউ ব্যতিক্রম ছিলেন। ঠিকই পাখির চোখে দেখেছে পুর্ব অঞ্চলের উন্নত চিন্তার ধরনকে। এঁদের মধ্যে মৈত্রেয়ী দেবী একজন। অন্ধকার অঞ্চল বলে যেটাকে এতদিন জেনে এসেছেন, সেখান থেকে তীব্র উজ্জ্বল আলোরচ্ছটা বিচ্ছুরিত দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই বিস্ময়কেই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন এভাবে।
“১৯৪৪ সালে যখন কলকাতার দাঙ্গা বাঁধে তখন এদিকের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও গাল গল্প গুজবে পাকিস্তানের যে চিত্র ফুটে উঠেছিল তা ভয়াবহ। যেন সমস্ত পূর্বপাকিস্তান একটি দানব অধ্যুষিত দেশ ও সেখানে ইতর ভদ্র সকল ব্যক্তি ছুরি হাতে ‘কাফেরের’ জীবন নাশের আগ্রহে ও নারী ধর্ষণের পৈশাচিক উল্লাসে প্রমত্ত – যেন সেখানে, কোনো হিন্দুর প্রাণ নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় কোনো নারী – এবং ধর্মীয় গোঁড়ামীর শৃঙ্খলে ধর্মরাষ্ট্রের সকল নাগরিক আষ্টে পৃষ্ঠে বাঁধা।
সেই সময়ে আমরা সাম্প্রদায়িক বুদ্ধির যে প্রমত্ততা এই বাঙলা দেশের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে দেখেছিলাম তাতে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। যে দেশে এত ঘটা করে রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়, সেই দেশেও যদি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এমন ভাবে বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করতে পারে, তবে তার বিপদ কতখানি তা সহসা উপলব্ধি করলাম। সেই সময় থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার জন্য ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে আমরা সমচিন্তা সম্পন্ন কয়েকজন একত্র হয়েছি।নানাভাবে সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিকে পরিষ্কার করার কাজে নেমে সহসা পূর্ব পাকিস্তানের পত্র পত্রিকা হাতে পেয়ে সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারীর ‘ভাষা আন্দোলনের’ সংবাদ সামান্য সামান্য এদেশের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তার যথার্থ রূপটি এবং তার ভিতরের অর্থটি আমার কাছে এবং আমার মত বহু ভারতীয় বাঙালীর কাছেই অজ্ঞাত ছিল। যদিও তখন পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ পত্র কলকাতায় নিয়মিত আসত, তবু দুচারজন ছাড়া হিন্দু বাঙালীর কাছে এবং বেশিরভাগ এদিকের মুসলমান বাঙালীর কাছেও তা অজ্ঞাত ছিল। এদেশের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তার যথার্থ রূপটি এবং তার ভিতরের অর্থটি আমার কাছে এবং আমার মত বহু ভারতীয় বাঙালীর কাছেই অজ্ঞাত ছিল। যদিও তখন পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ পত্র কলকাতায় নিয়মিত আসত, তবু দুচার জন ছাড়া হিন্দু বাঙালীর কাছে এবং বেশীর ভাগ এদিকের মুসলমান বাঙালীর কাছেও তা অজ্ঞাত ছিল। এদেশের পত্র পত্রিকায় আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী সম্বন্ধে বড় বড় প্রবন্ধ লেখা হছে কিন্তু পূর্ব বাঙ্গলার নবজাগরণের সমস্ত সংবাদ ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত একেবারেই অনুচ্চারিত ছিল। গোপন করা হয়েছিলই বলব, কারণ যাঁরা সংবাদ সরবরাহ ও সংগ্রহ করেন তাঁরা জানতেন না একথা বিশ্বাস হয় না পূর্ব বঙ্গের অগ্রসর সমাজের চিন্তার বিবর্তন অবশ্যই ওয়াকিবহাল মহলে জানা ছিল কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক সেটা এদেশের অধিকাংশ লোকের মনে বিশবছর আগের পাকিস্তান আন্দোলনের চিত্রটিই স্থির ছিল এবং পাকিস্তান সরকার ও তার জনগণের মধ্যে যে পার্থক্য ক্রমেই প্রসারিত হয়ে দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গী বিপরীতমুখী হচ্ছে সে সত্য একেবারেই আবৃতি ছিল। কাশ্মীরে হজরতবালের মসজিদ থেকে হজরতের চুলটি খোয়া গিয়েছে এই গুজব ছড়ানো ও কোনো স্বার্থন্বেষী মুসলিম মন্ত্রী খুলনাতে মিল মজুরদের উস্কানী দেওয়ার ফলে সেখানে দাঙ্গা ঘটে ও দলে দলে ভীত আর্ত মানুষ ভারতে আসতে থাকে সেই সময়ে বদলা নেবার উৎসাহে ৮/৯/১০/১১ জানুয়ারীতে কলকাতায় আগুন জ্বলছিল তখন হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রের ভূমিকা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কি উদার নির্ভীক কণ্ঠে সমস্ত বাঙালী মুসলমান শুভবুদ্ধির আহবান জানিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন ধিক্কার সরকারী নিস্ক্রিয়তাকে।”
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে, প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারার মানস প্রতিভূ হচ্ছে পাকিস্তান। কিন্তু, এর জন্মের পরপরই বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে বাঁচার জন্য রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেদের নিয়ে এসেছে তারা। ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দুর্গন্ধময় গোবরে এ যেনো সুগন্ধময়, অপরূপ সুশ্রী ফুটন্ত এক পদ্মফুল। ধর্মরাষ্ট্রের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার এই চরম উৎকর্ষ দেখে হতভম্ব হয়েছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। তাঁর এই উচ্ছ্বাসকে, নব আবিষ্কারকে নিজের মধ্যে দমিয়ে রাখেন নি তিনি। বরং দামামা বাজিয়ে জানানোর চেষ্টা করেছেন সকলকে। তিনি লিখেছেন,
“সেই দাঙ্গার সময় পূর্বপাকিস্তানের বাঙালী সমাজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল যে আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটতে পারবে না এবং তার সূত্রপাত হলে দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে লড়তে হবে। এরই ফলে কলকাতার দাঙ্গার বদলা হিসাবে নারাণগঞ্জে আদমজীমিলে যে দাঙ্গা সুরু হয় তা দুদিনে বন্ধ হয়ে গেল ও রূঢ়কেল্লার ভীষণ দাঙ্গার কোনো বদলা পাকিস্তানে হতে পারল না। জনসাধারণের এই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংকল্পবদ্ধ অভিযান সম্ভব হয়েছে সেখানকার লেখক সাহিত্যিক সংবাদপত্র পত্রিকার দ্ব্যর্থহীন নিন্দাবাণী গুণ্ডাবাজ স্বধর্মীদের প্রতি ক্রমাগত ঘোষিত হয়েছে বলেই।
ধর্মরাষ্ট্রের মধ্যে কখন ধীরে ধীরে সেকুলার চরিত্র গড়ে উঠল এ দেশে বসে আমরা তার কিছুই সংবাদ রাখিনি-লজ্জার ও বেদনার সঙ্গে এই সত্যর মুখোমুখী হবার পরই ‘নবজাতক’ পত্রিকা প্রকাশ করে আজ ছয় বছর হল ক্রমাগত পূর্বপাকিস্তানের লেখকদের রচনা প্রকাশ করে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেছি।“
পাকিস্তান ছিলো ধর্মরাষ্ট্র। সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধে তারা ঢোকানোর চেষ্টা করেছে ধর্মের বিষবাষ্প। এর বিপরীতে বাঙালি স্বপ্ন দেখেছে এক সেকুলার রাষ্ট্রের, অসাম্প্রদায়িক এক সমাজের। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি এবং পাকিস্তানিদের পথ গিয়েছে সম্পূর্ণ দুইদিকে বেঁকে। বাঙালি তার স্বপ্নপূরণে নেমেছে আন্দোলনে, ঝরিয়েছে বুকের রক্ত। তারপর অর্জন করেছে সেকুলার এক দেশ। কিন্তু, তারপর? তারপরই ঘটেছে সবচেয়ে হতাশাজনক ঘটনাটি। একটি সেকুলার রাষ্ট্রকে, সমাজকে বাঙালি অকস্মাৎ পরিণত করে ফেলেছে এক ধর্মরাষ্ট্রে। শুরুতে একে ধরা হয়েছিলো বিচ্ছিন্ন এক ঘটনা হিসাবে, অযাচিত এক দুর্ঘটনা হিসাবে। কিন্তু পরে দেখা গিয়েছে যে, আসলে তা ছিলো না কোনো দুর্ঘটনা, কিংবা আকস্মিক কোনো ঘটনা। স্বাধীন রাষ্ট্রে বাঙালি সেকুলারিজম চায় নি, হেঁটেছে ধর্মরাষ্ট্রের পথে। তার চলনে, বলনে, আচার-আচরণে ফুটে উঠেছে তার মুসলিম মানসিকতা।
আর, এই মানসিকতার সাথেই তাল মিলাতে গিয়ে আপোষ করেছেন রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু। হাজার হোক রাজনীতিবিদ তারা। জনগণকে নিয়েই তাঁদের কায়কারবার। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য তাঁদের কাছে অনেক। জনগণের ইচ্ছার বৃষ্টি যে দিকে হবে, রাজনীতিবিদেরা তাঁদের ছাতাও সেদিকেই খুলে ধরবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিক কাজটাই করেছেন তাঁরা সময়ের প্রয়োজনে।