আজ হরতাল সেইসাথে সকাল বেলাতেই একটা মৃত্যু সংবাদ পেলাম !
কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে বেশ বিরক্ত লাগছে । মনের মধ্যে অনেকটা অস্বস্তি নিয়েই ব্রাশে পেস্ট মাখাচ্ছি । অবশ্য বিরক্ত ভরা চেহারাতে একটা শোকাবহ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে চলছি কারণ নাহলে আবার বউয়ের সাথে ঝগড়া হয়ে যেতে পারে কেননা মৃত ব্যক্তি আমার ছোট মামাশ্বশুর । নাস্তার টেবিলে বসে নীড়ার মানে আমার বউয়ের সামনে নিজের মধ্যে মিথ্যে শোকের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম । মনে হয় অভিনয়ে পাশ করে গেছি । কারণ এখনও নীড়া আমাকে কিছু বলে নি । সুতরাং আমারই এখন কিছু মিথ্যা কথা বলা উচিত ; মানে মৃত মামাশ্বশুরের প্রশংসা করা উচিত । যেমন , আহারে লোকটা বেশ ভালো ছিল ( মোটেও ভালো ছিল না , খাটাস প্রকৃতির লোক ছিল ) ; আমার খুব পছন্দের ছিল উনি ( এটা ঢাহা মিথ্যা কথা কারণ খাটাস প্রকৃতির কাউকে আমার ভালো লাগার প্রশ্নই আসে না ) ।
লোকটাকে পছন্দ করার কোন কারণ ছিল না ঠিকই কিন্তু অপছন্দ করার হাজারো কারণ ছিল । এইতো গতবছর উনার মেয়ের বিয়ের জন্য আমাকে ভালো পাত্র দেখতে বলল । আমিও ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিলাম । আমার বন্ধু মুহিবকে নিয়ে একদিন উনার অফিসে গেলাম কারণ পাত্র হিসাবে আমার বন্ধু খুবই ভালো । মুহিব সিলেট মেডিক্যাল থেকে পাশ করে এখন বিসিএস দিয়ে সরকারি ডাক্তার হয়েছে । তাই পাত্র হিসাবে তাকে একেবারে রসগোল্লার ক্যাটাগরিতে না ফেললেও চোখ বন্ধ করে চমচমের মধ্যে ফেলা যায় । মুহিবের সাথে আমার ছোট মামাশ্বশুর কিছুক্ষণ আলাপ করার পর আমাকে কানে কানে বলেন , ” তোমার বন্ধু কি মানুষের ডাক্তার নাকি ঘোড়ার ডাক্তার ? এর শরীর থেকে ঘোড়ার আস্তাবলের গন্ধ বের হচ্ছে কেন ? এই ছেলের সঙ্গে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিব না । নাহলে বিয়ের পরে দেখা যাবে আমার মেয়ের শরীর থেকেও ঘোড়ার আস্তাবলের গন্ধ বের হবে ” ।
আর এই কথা বলেই খিক খিক করে এমন হাসি দিলেন যে ভয়ে আমার লোম খাড়া হয়ে গেল । এর পর থেকে এই লোকটি থেকে আমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি ।
আমার মুখ খোলার আগে নীড়াই জিজ্ঞেস করল ,
— তুমি কি আজই যাচ্ছ ?
— হু ।
— তারমানে মামা মারা গেছে আর সেখানে তুমি যাচ্ছ না ?
— না ।
— তাহলে এতটা রাস্তা আমি একাই যাচ্ছি ?
— আমি নিরুপায় । দেখি কি করা যায় । দেখি আমি অরূপকে বলে দেখি সে যেতে পারে কিনা ।
— থাক তোমার আর দেখতে হবে না । আমি একাই যেতে পারব । আর সেখানে তুমি না গেলে যে সবাই ছিঃ ছিঃ করবে এটা তো নিশ্চই বুঝতে পারছ । আর তুমি এটাও জান যে , তোমাকে নিয়ে কেউ কোন বাজে কথা বললে সেটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না ।
— দেখ সব বিষয় নিয়ে মাথা গরম করলে কোন সমাধান আসে না । আমার আর্জেন্ট কাজ পরে গেছে । নাহলে আমি অবশ্যই যেতাম । আর আজকের কন্ট্রাক্টা মিস হয়ে গেলে অনেকগুলো টাকা হাতছাড়া হয়ে যাবে ।
— তাহলে টিকেট একটাই কাটব ?
আমি জবাব দিলাম না কারণ ধ্বনি করলেই নাকি প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হয় আর এই মুহূর্তে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছাও আমার নেই । সবচেয়ে বড় কথা আমি ভালো করেই জানি তাকে বলে কোন লাভ হবে না । নীড়া ভাঙ্গবে কিন্তু মচকাবে না টাইপ মেয়ে । তাই ওকে আটকানোর ক্ষমতা আমার নেই ।
দুপরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম । অবশ্য আমার আগে নীড়া বের হয়েছে । বেচারিকে একা যেতে দেখে খুব কষ্টই হচ্ছিল কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম । আজকের কন্ট্রাক্টাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ; রুটি-রুজি কা সাওয়াল । গলি থেকে বেশ খানিকটা হেটে মেইন রাস্তায় পা দিলাম । চারিদিকের পরিস্থিতি অনেকটা থমথমে । খানিক বাদে বাদেই সাইরেন বাজিয়ে বাজিয়ে পুলিশের গাড়ির টহল । এমনিতেই কাজের সময় রিক্সা পাওয়া দায় আর আজ হরতালের দিনে তো তাদের মচ্ছব । কিছুটা দুরে একটা খালি রিক্সা দেখে এগিয়ে গেলাম । রিকশাচালক বেশ আয়েসি ভঙ্গিতে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে যেন এই মাত্র বিয়ে খেয়ে এসেছে । কোনরকম দরদাম না করেই উঠে বসলাম । রিক্সা এগোচ্ছে শম্বুক গতিতে । পকেট থেকে মোবাইলখানা বের করে ফেসবুকে একটু ঢু মারার চিন্তা হতেই লগ অন্য করে ফেললাম । হোম পেজে প্রথম স্ট্যাটাসটা দেখেই বুকে ধড়াস করে একটা বাড়ি খেল । এক জন স্ট্যাটাস দিয়েছে , ” এই রায় মানি না ” ।
ওহো আমিতো ভুলে গিয়েছিলাম আজকে রাজাকার কসাই কাদেরের রায় । হোমের একটু নিচে নামতেই দেখি এইরকম অসংখ্য স্ট্যাটাস । তার মানে কসাই কাদেরের ফাঁসির আদেশ হয়নি ! কয়েকজনতো দেখি রীতিমত এই যাবজ্জীবন রায়ের প্রতিবাদে ইভেন্টও খুলে বসেছে । মাথাটা সেই মুহূর্তে ঠিক কাজ করছিল না , স্ট্রোক করেছি নাকি আমি তাও বুঝতে পারছি না । একটা ইভেন্টের স্থান দেখলাম জাদুঘরের সামনে ।
রাগে দুঃখে শরীরটা যেন শ্লথ হয়ে পড়ছে ক্রমাগত । এটা দেখার জন্যই তাহলে বাঙ্গালীর ৪২ বছরের অপেক্ষা ! কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে রিক্সা-ওলাকে শুধু বললাম , শাহবাগ যাও । রিক্সাওয়ালাও কথা না বাড়িয়ে শাহবাগের রাস্তা ধরল । কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহবাগ যাদুঘরের সামনে চলে আসলাম । দেখি কয়েকজন ইতোমধ্যে চলেও এসেছে । একটা কমবয়সী ছেলে দেখলাম গলায় একটা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে আসল আর তার প্ল্যাকার্ডে বড় বড় করে লিখা ” কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই ” । আজ সবার দৃষ্টিই কেন জানি অন্যরকম লাগছে । আগুন আগুন দৃষ্টি সবার চোখে , মনে হচ্ছে অনেক দিনের কোন সুপ্ত অথবা মৃত আগ্নেয়গিরি যেন আবার লাভার উৎপাত করছে । ফোনে রিং বেজে উঠল । চেয়ে দেখি আজকে যে সাপ্লাইয়ারের সাথে কন্ট্রাক্ট হওয়ার কথা তার ফোন । কলটা রিসিভ করেই কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম ,
— আমি আজকে আসতে পারব না ।
— না আসলে ওস্তাদ আপনেরই লস । আমি মাল অন্য কাস্টমারের কাছেই ………
— মাল ভিজিয়ে মুড়ি খা …
আর কোন ধরনের কথা না বাড়িয়ে লাইনটা কেটে দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকলাম । এরই মধ্যে বেশ কিছু মানুষ চলে এসেছে । রাস্তায় বসে কয়েকজন ছেলেমেয়ে আর্ট পেপারে বিভিন্ন শ্লোগান লিখছে । আমি তন্ময় হয়ে দেখতে লাগলাম সব কিছু । মুহূর্তেই আরও শখানেক মানুষের আগমন । সবার চোখে যেন বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে । সময়ের সাথে যেন আগুনের তাপ বেরেই চলছে ।
সময় বিকাল চারটার কাছাকাছি । দেখতে দেখতে মানুষের উপস্থিতি যেন আরও বেড়ে গেল । প্রতিবাদ জানাতে জাদুঘরের সবাই একটা লাইনে দাঁড়িয়ে গেল । আমিও সেই লাইনের একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলাম । হটাত আমার ডান দিকে একটু দুরে লাইনে দাঁড়ানো একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ আটকে গেল । চোখে চোখ পড়তেই বুঝতে পারলাম ; সে আর কেউ না , নীড়া ।