অভিশাপে লাভ ক্ষতি

নেয়ামুল প্রায় দৌড়ে চলতে থাকে। তার মাথার ভিতর এখন কিলবিল করছে।

মাথা থেকে পোকাগুলো ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত চলবে বিরামহীন প্রসব বেদনা। ঢিমে তালে চলতে থাকা একটি বাসে নেয়ামুল উঠে পরে। একটু পরেই নেয়ামুলের হুশ হয় যে বাসটা বিশাল নিতম্বের হেলেদুলে চলা মেয়েছেলের মত চলছে। এই চলা যেন কেয়ামতের আগে শেষ হবেনা। অন্য দিন এই সব বাসেই নেয়ামুলের খোদা প্রদত্ত রেডিওটা বিরামহীন চলতে থাকে। কেউ শুনছে কি শুনছেনা তাতে রেডিওর ভ্রুক্ষেপ নেই কারন রেডিওরতো কান চোখ থাকেনা, থাকে শুধু মুখ।

বাসে উঠেই চিলের চোখ দিয়ে দেখে, কোন সিট খালি আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে দেখে কোন সিটে পরিচিত ছোট ভাই বসে আছে কিনা যদি থাকে তাহলে তাকে ইঙ্গিতে, ইঙ্গিতে কাজ না হলে মুখেই বলে উঠবেঃ

ছোট ভাই একটু বইতে দিও বা কিরে পোলা ঘস্তে ঘস্তে তো সিটের কাপড় ছিড়া ভিতরের নরম ফোম বাইর কইরা ফেলবি।  ওঠ! একটু ভাই বসবার দে। কোনরকমে একটা চেয়ারে বসে পরেই সে শুরু করে বিজ্ঞাপন মুক্ত সম্প্রচার। এই রেডিওর আরজে ঘোষক পাঠক গায়ক সব কিছুই সে।

নেয়ামুল সিট খোজা বাদ দিয়ে বাস থেকে নেমে যায়। নেয়ামুলের নেমে যাওয়া দেখে কেউ চমকে যায়, কেউ হতাশ হয়, কেউ হাফ ছেড়ে বাঁচে।

ঐ রিক্সা যাবি ভাই? না করিস না ভাই,চল। এই বলেই রিক্সায় চেপে বসে,রিক্সা ওয়ালাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। রিক্সাওয়ালা প্যাডেল দেয়া শুরু করতেই নেয়ামুল বলেঃ

ভাই শুন দ্রুত প্যাডেল মার আমি আছিলাম বাসে। বাস হালায় চলতাছে পোয়াতির মত। খুব সাবধানে  চরম আস্তে।আর এদিকে মাথায় হালায় এতোগুলান কাম সিন্দাবাদের ভুতের মত চাইপা বইছে। তুই সরাসরি হাজী মোহাররমের ভিটার সামনে থাম্বি।

*

আজ থেকে মেলা বছর আগে, এই ৮ বছর তো হবেই।

আজাদের মা বিলাপ করে বিছানায় হাত মেরে কাঁদছে।আজাদের মায়ের কান্না দেখে শুনে যে কেউ আজাদের বাপের বাড়ীটাকে মাইয়েতের বাড়ী মনে করে বিভ্রান্ত হতে পারে।

আমার আজাদ। পোলায় আমার পড়াশুনায় খারাপ থাকলেও কামকাজে মতি আছিলো। হেই পোলায় শরিফের লগে আরও কয়েকজন ইয়ারদোস্তের লগে ওর ১৫ বছর বয়স থিকায় ব্যাবসাপাতি করলো। ৪/৫ বছর পরেই শরিফে কয় আজাদরে ঢাকা থিকা সরাসরি মাল আনলে লাভ বাড়বো। হেই শরিফ ঢাকায় গিয়া ঢাকা শহরে মানুষ বানাইয়া আইলো। দোকান আরও জমলো। ভাবলাম ছোড ভাইডা আমার সমস্যায় আছে তো ওর মাইয়াডা আজাদের লিগা নিয়া আহি। হায়রে আমার কপাল শরিফে সব নিয়া গেল। সব কাইচা নিয়া গেল আমার আজাদরে ফকির বানাইয়া।

পাশের ঘর থেকে আজাদ জোর গলায় বলেঃ

মা কাইন্দো না আমি তো আতুর হইয়া যাই নাই। সুস্থ হই তারপর গোয়ালের দুই তিনডা গরু বেইচা আবার শুরু করুম আবার শুরু করুম।  একলা নিজের পেলানে নিজে খাইট্টা সময় দিয়া নিজে নিজের পায়ে খারামু। এই কথা গুলো এবার আস্তে আস্তে সে বলতে থাকে নিজেকে সাহস দেয়ার জন্য।আজাদের মা ছেলের কথা শুনতে যেয়ে চুপ করতে বাদ্ধ হয়। ছেলে চুপ হয়েছে নিশ্চিত হয়ে আবার শুরু করে ধারা বিবরণী।

পোলায় আমার সাহস আছে অচেনা শহর ঢাকায় রওয়ানা দেয়। এতো দিন তো হে ঢাকায় যায় নায় কইতো মা বুজলা সবায় ঢাকায় গিয়া বইইয়া থাকলে হইবো। আমি দোকান সামলাই আর শরিফে ঢাকায় গিয়া মাল আনবো। অতো আর পিকনিকে যায়না যে লগে আমারো দোকান পাট ফালাইয়া যাইতে হইবো।

আমি আমার পোলারে নিজ হাতে খাওয়াই আমার সোনার টুকরা পোলা। সকাল নাই দুপুর নাই রাইত নাই দিন নাই শরিফ যে কোন সময় বাইত্তে আইয়া পরে।

ওরে দেইখা আমি কই যে যে শরিফ তুই বয় আমি আমার হাত দিয়া একবার আজাদের মুখে লোকমা তুইলা দেই হেরপরে আবার শরিফের মুখে।  হেই সিন দেখলে কেডা না ভাবতো যে আমার দুই পোলা। শরিফ আর আজাদরে আমি নিজ হাতে খাওয়াইয়া দিতাছি। হেই শরিফে নি টাকা পয়সা নিয়া ঢাকায় থাইকা গেল।

পোলার আমার দিল সাফ হইলেও কলিজা বড়। গেল ঢাকায় গিয়া নাকি শরিফরে কইবো দেখ তুই কি গেরামে না আইয়া পারবি আইজ হোক আর কাইল হোক তুই আবিই। যা হইছে হইছে মাল নিয়া তুই আমি চল গেরামে ফিরত যাই। হেই পোলার কতা শুনবো পরের কতা আমার পোলারে মারার লিগা ঢাকায় শরিফ নাকি লোক বানায়।

আজাদ বিছানায় শুয়ে শুয়ে মায়ের বিলাপ শুনে কিন্তু আজাদের মধ্যে যেন মাড়োয়াড়ি রক্ত।সে তার মায়ের বিলাপ কে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে গলা দিয়ে কলিজায় না ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে সেই বিলাপকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বেড় করে দেয়। সে ভাবতে শুরু করে গরু বেচে শুরু করতে হবে। এর পর কোমরটা একটু শক্ত হলেই শরিফের খোঁজ লাগাতে হবে। সাথে সাথে না, ধিরে ধরতে হবে।

নাহ ধইরা সাইজ কইরা লাভ নাই আগে টাকা উশুল সুদ সমেত তারপর দেখা যাবে শাস্তি কি দেয়া যায় আর কতটুকু দেয়া যায়না।

মা বিলাপের মাঝে শাপ দেয়া শুরু করে ওরে শরিফরে এই হাতে আমি তোরে খাওয়াইছি তুই আমার পেটে না হইয়াও পেটের পোলার মত ছিলি। তোর মাথাত গজব পড়বো। তোর সংসারে গজব পড়বো।  তোর রিজিকে গজব পড়বো । তোর জীবনে কোন দিন বরকত হইবো না।  যা তোরে অভিশাপ দিলাম মনে রাহিস এইডা এক মায়ের অভিশাপ যার হাতে তুই খাইছিলি।

আজাদের মায়ের বিলাপে শরিফ, আজাদ, লোকমা, দানা, নিজের হাত, পোলার মত, এই সব অমীমাংসিত সম্পর্কের ফলাফল হেড স্যারের মুখে রেজাল্ট ঘোষণার মত চলতে থাকে।

শরিফ আজাদের থেকে আমানতদারী না শিখতে পারলেও ‘ব্যাবসায় পরিকল্পনা পরিশ্রম সময় ব্যায়’ এই সব ঠিকই শিখতে পেড়েছিল। শরিফ এখন শরিফ সাহেব।

তার পিছনের কথা এখন রূপকথা। সেই রূপকথা রূপকথার শাঁকচুন্নির মত তাদের গ্রামের শ্যাওড়া গাছেই আশ্রয় নেয়। সেই শাঁকচুন্নি ঢাকা শহরের ইট কাঠ লোহার দালান কোঠায় নগর জীবনে ঠাই পায়না।

সাইদের কি কাজ? সাইদের কোন কাম কাজ নাই। একেবারেই যে নাই তা না মানুষে বলে আকাম কুকাম। সাইদ জানে কোন স্কুলটা শুধু মাত্র মেয়েদের। কোন মেয়েদের স্কুলে কয়টা শিফট।কোন স্কুলে ছেলে মেয়ে দুইটাই আছে কিন্তু শিফট আলাদা। আর কোন স্কুলে ছেলে মেয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেহায়ার মত ক্লাস করে। কখন মেয়েরা স্কুলে ঢুকবে কখন বেড় হবে। মেয়েদের পরীক্ষা শেষে কবে থেকে কবে পর্যন্ত ছুটি। সাইদ না স্কুলের দপ্তরি, না স্কুলের গেটের দারোয়ান। না সে গেটের সামনে বাদাম মালাই বরফের ফেরিওয়ালা। সে হল হলুদ রঙের প্যান্ট পড়া,  চকমকে লাল নিল সবুজ রঙের গেঞ্জি সার্ট পড়ে, নীল রঙের ফ্রেম আর গোলাপি রঙের কাঁচ বা প্লাস্টিকের রোদ চশমা কান নাকের উপর বসিয়ে রাখা একজন পুরুষ মানুষ। মাঝে মাঝে জোকারের মত দেখতে তার চশমাটা হাতে নিয়ে শিশুপার্কের চরকির মত ঘুরাতে থাকে। এই লাইনে দক্ষতার জন্য সে কিছু চ্যালা চামুণ্ডাও পেয়ে যায়।

শরিফ যখন ঢাকায় মানুষ বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে ঘুরছে তখন সাইদের চেয়ে সস্তা কাজের লোক সে কোথায় পাবে। শরিফ সাইদকে বুঝাতে পারে যে স্কুল সকাল থেকে বিকাল , রবি থেকে বৃহস্পতি খোলা থাকে। জামা কাপরে লাল নীল হলুদের চকমকানি থাকলেই হবে না, পকেটও ভারী হতে হবে। আর পকেট ভারী হবে এই অল্প বিস্তর চেষ্টায়। এই চেষ্টায় আবার কোন তেমন কষ্ট নেই। আছে নায়কগিরি।

সিনেমার নায়কের মত হেটে যাইবা, নায়কের মত কিছু ডায়ালগ দিবা, নায়কের মত একটু সাইজ দিবা দেখবা এরপর আর নায়কের মত রিক্সা চালাইতে হবে না।  রিক্সায় নিজে উঠবা লগে কোন হুর পরী মালও উঠাইতে পারবা। শুনো মিয়া ফকির নায়ক পোষায় না, পকেট ভারী নায়ক দরকার।

কুকুরের নাকে হাড্ডির গন্ধ লাগলে যা হয় আর কি। শরিফ অল্প কথায় সস্তায় সাইদের নাকে গন্ধ লাগিয়ে দিতে পারলো।

আজাদরে দাবড়ানি পিটানি লুলা বানানোর আগে সাইদরে চা চটপটি সিনেমা আর হাতে গোল্ড লিফের ভাব দিয়া বাজাইয়া রাকছে সে। আজাদরে দাবড়ানি দেয়ার পর সাইদের হাতটাও খুলে গেছে তা লক্ষ করে শরিফ। সাইদও বুঝে শরিফরে শরিফের মত ছাইড়া দিলে হইবো না। হাতের মইদ্ধে বাজাইয়া রাখতে হবে। শরিফও সাহস পায়না অন্য এলাকায় যাইতে। তো কি আর করার সাইদরেও সে হাতের মইদ্ধে বাজাইয়া রাখে।

সাইদের ছায়ায় আজাদের টাকায় শরিফ বাড়তে থাকে সাথে সাথে। সাইদও বাড়তে থাকে পরগাছার মত।

সাইদের জামা কাপড়ে চ্যাঞ্জ আসে।  সে এখন মাঝে মাঝে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পড়ে। ভদ্রলোকের মত ভদ্র ধাঁচের সার্ট প্যান্ট পড়ে। একটা হুণ্ডা সে হাকায়।

শরিফ আর সাইদ মনে মনে এখন চার চাকার কথা ভাবে কিন্তু সামনে নির্বাচন।

নির্বাচন হোক আর না হোক শরিফ একটা গাড়ী সে কিনতেই পারে।  শুধু একটা না দুটা কিন্তু গেরামের পোলা এহনো হাত খুলে নাই। তবে ব্যবসায় জুয়া খেলা শিকছে  হান্ডেডে হান্ডেড।

শরিফ বলেঃ

আমি হাজী জালিমের পিছনে টাকা খাটামু।

সাইদ বলেঃ

হ ভালো কইছ মামু!  হাজী জহুদ জিত্তা আইলে যাতে তোমারে হান্দাইতে পারে।

শরিফ কয়, তো?

সাইদ সমাধান দেয়। আমি খাডামু হাজী জহুদের পিছনে আর তুমি হাজী জালিমের পিছনে। হাজী জালিম আমার মামু গো ইয়ার দোস্ত।  হে জিতলেও আমাগোরে দেখবো,  হারলে আমরা আছি তার লগে।

শরিফ জুয়াড়ি হলেও একটু ভয় পায়। কিন্তু পিছে ফিরে গেলেও যে জুয়া বন্ধ হয় না। জুয়া এখন অটো স্টার্ট হইয়া আছে কেউ থামাইবার পারবো না।

নির্বাচনে হাজী জহুদ জিতে যায়। আর সাইদ সবার আগে যায় হাজী জালিমের কাছে তাকে যেয়ে সান্তনা দেয়। আর বলে মামু আমরা আছি কোন প্রবলেম নাই।

সাইদ হাজী জহুদের কাছে যেতেই হাজী জহুদ ওকে বুকে জড়িয়ে নেয়।

বেটা তোগো লিগাই জিততে পারছি। শাবাশ বেডা।

 

শরিফ বুজতে পারে যে খেলার শুরু শুরু আছে শেষ নাই।  শরিফ ক্যাশ টাকা ওর একটা গোপন হিশাবে ঢুকাতে থাকে।

সাইদ এবার শরিফ সাইদের ব্যাবসায় হাজী জহুদরে সাথে নেয়। সাইদ বুজতে পারে শরিফ ক্যাশ গুছাইতাছে। শালা মাঙ্গের পো কলা গাছ ধইরা ঢাকা শহরে আইচিলা।

এবার আবার ফেরত যাও। ক্যাশ যা পারছ নে মাগার সম্পত্তিতে হাত দিবিনা।

শরিফ দেখে কর্মচারীগুলো পর্যন্ত অন্যরকম ভাব নেয়া শুরু করেছে। শরিফ সাইদের সাথে মিটিং এ বসে।

শরিফঃ সাইদ আমি ভাবতাছি গেরামে একবার যামু। আমার মামু তো চেয়ারমেন। মামু কইল আইজকাইল নাকি গেরামেও ব্যাবসা আছে। করবা নাকি?

সাইদ মুচকি হাসে। দোস্ত ভালো কইছ হ করুম তই এহন না কিছু দিন পরে।

সাইদ মনে মনে বলে কলাগাছ তুই আমারে কি মগা পাইছছ? শালা তুই আসলে আমারে অফার দিয়া কিছু দয়া চাইতাছছ। দয়া তো তোরে করতাছি তোরে হাজীরে কইয়া গুম না কইরা তোরে ক্যাশ টেকা সরাইবার দিতাছি। গেরামের পোলা গেরামে গিয়া ব্যাবসা কর।

শুনো দোস্ত তুমি কবে দেশে যাইবা? টাকা পয়সা প্রয়োজন মত নিয়া যাইয়ো। এতো দিন পর ঢাকা থিকা গেরামে যাইবা গেরামের মানুষরে গরু কাইটটা খাওয়াইতে হইবো না।

 

You may also like...

Read previous post:
নিঃসংগ যুবকের মনোস্তাত্তিক যুদ্ধঃ শেষ পর্ব

বিকাল পাচঁটা। প্রফেসর ডক্টর নেয়ামত আলীর চেম্বার। ডক্টর নেয়ামত আলী মনোযোগী শ্রোতা। সকাল বলে যাচ্ছে তাঁর ভেতরের না বলা কথাগুলো।...

Close