বিকাল পাচঁটা। প্রফেসর ডক্টর নেয়ামত আলীর চেম্বার। ডক্টর নেয়ামত আলী মনোযোগী শ্রোতা। সকাল বলে যাচ্ছে তাঁর ভেতরের না বলা কথাগুলো। কিছুক্ষন শোনার পর তিনি সকালকে থামিয়ে দিয়ে ইন্টারকমে চাপ দিয়ে এসিস্টেন্টকে ডাকলেন; বলে দিলেন আজকে তিনি আর কোন রোগী দেখবেন না। কেউ যাতে তাকে বিরক্ত না করে। সকাল আবার শুরু করল। সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তাঁর ভেতরের বাহিরের প্রতিটা কথাই ডক্টর আঙ্কেলের সাথে সে বলে যাচ্ছে। ডক্টর নেয়ামত আলীও যেনো গোগ্রাসে গিলছেন সকালের মুখ থেকে বের হওয়া কথাগুলো। সকাল তাঁর বাম পায়ের হাটুর নিচের অই বাড়তি অংশটা কেটে ফেলে দেয়ার ইচ্ছার কথাটা ডক্টর আংকেলকে নির্দ্বিধায় বলে দেয়। ডক্টর নেয়ামত আলী অভিজ্ঞ ডক্টর, তিঁনি বিচলিত হন না। যদিও এই টাইপের কেস তিনি এই প্রথম হ্যান্ডেল করছেন, তিনি এই রোগটা সম্পর্কে জানতেন বেশ আগে থেকেই।
সুস্থ-সবল একটা ছেলে যদি ডক্টরের কাছে এসে বলে ডক্টর আমার বাম পা এর হাটু থেকে নিচের অংশটা কেটে ফেলে দিন ওটা আমার না- তাহলে সে ডক্টর নিশ্চিতভাবেই বিশাল একটা ধাক্কা খাবেন, কেউ কেউ আবার মুর্ছাও যেতে পারেন। ডক্টর নেয়ামত আলী আকস্মিক ধাক্কাটা বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন। সকাল আবার বলে ওঠে, আঙ্কেল আমি সজ্ঞানে এবং সুস্থ মস্তিষ্কেই কথাটা বলছি- আমি আমার বাম পায়ের অই নিচের অংশটুকু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারনের উদ্দেশ্যেই এসেছি আপনার কাছে।
প্রফেসর ডক্টর নেয়ামত আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার ঝানু একজন লোক। ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন টানা ২৫ বছর। নামকরা একজন সার্জন। সবাই তাকে একনামে চেনে। যে কোন রোগীর যে কোন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অসামান্য দক্ষতা আছে তাঁর। সকালের মুখে কথাগুলো শুনে কিছুক্ষন চুপ থাকলেন তিনি, তারপর শুন্য দৃষ্টি নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। পড়ন্ত বিকেল। এ সময়টাতে তিনি এক কাপ চা খান নিয়ম করে।
– কি খাবা সকাল? আমি চা খাবো।
– কিছু না আঙ্কেল, আপনি চা খান।
– কিছু তো একটা খাবাই।
– ঠিক আছে, চা দিতে বলুন।
চা আসতে সময় লাগল না; ইন্টারকমে চাপ দিতেই দু’কাপ চা এসে হাজির। যেনো এসিস্টেন্ট চা এর ট্রে হাতে নিয়ে দড়জার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সকাল চা খাচ্ছে। নেয়ামত আলী সাহেব উদাস ভঙ্গিতে জানার বাইরে তাকাচ্ছেন আর সুরুত সুরুত করে চা এর কাপে চুমুক দিচ্ছেন। সকালের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তিনি ড্রয়ার থেকে বেন্সন লাইটস এর প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন। আয়েশি ভঙ্গিতে সিগারেট টানছেন তিনি। সাজানো গোছানো চেম্বার, খুব একটা আলোর ঝলকানি নেই আর এই মুহুর্তে কিছুটা নৈঃশব্দ বিরাজ করছে।
– আচ্ছা, সকাল।
– জ্বী আঙ্কেল।
– তুমি কি জানো তোমার সমস্যাটা কি বা কোথায়?
– আমার সমস্যাটা মানসিক নয় এটুকু জানি।
– কি করে বুঝলে?
– আপনার কলমটা দিন আমি দাগ কেটে বলে দেই আমার পায়ের নিচ থেকে কোন অংশটুকু আমার নয়। আমি ঠিকঠিক বুঝতে পারি এবং অনুভব করি আঙ্কেল।
– Ok Ok I See… তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি। তুমি আসলে ভুগছ বডি ইন্টিগ্রিটি আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডারে। এই পৃথিবীতে একা নও তুমি। তোমার মস্তিষ্কে তোমার শারীরিক যে আকার তৈরি আছে সেখানে বাম পায়ের অই নিচের অংশটুকু অনুপস্থিত। মূল ব্যাপারটা এখানেই। আর সে কারনেই অই অংশটুকু তোমার কাছে অচেনা মনে হয়, মনে হয় অন্য কারো।
– আঙ্কেল সে যাই হোক, আমি চাই ওটা কেটে ফেলে দিতে। তা না হলে আমার শান্তি নেই- আমি কখনো অন্য সবার মত স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে পারব না; আমার জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়বে। আমিতো সেটা চাই না।
– সকাল আমি তোমাদের ব্যাপারে জানি। তোমরা যা বল সেটা তোমাদের মস্তিষ্ক-প্রসূত চিন্তাই, মনগড়া কিছু না। তুমি যা চাইছো সেটা আমার পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে অনেক ব্যাপার আছে সকাল। তবে আমি আশ্বাস দিচ্ছি, তোমাকে সাহায্য করব আমি। তুমিতো ঠিকমত ঘুমাও ও না চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এখন বাসায় যাও তুমি, দেখি কি করতে পারি আমি তোমার জন্য।
সকাল ডক্টর আঙ্কেলের চেম্বার থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাটছে। আজ সে হেটেই বাসায় যাবে। ইতিউতি তাকাচ্ছে আর হাটছে, হাটছে আর ভাবছে। সে হঠাত সিদ্ধান্ত নেয় আজই সে বাসায় সব বলবে। রাতে বাবা বাসায় ফিরলে মা-বাবা দুজনকেই ডেকে বারান্দায় বসিয়ে তাঁর ভেতরের কথা আর ইচ্ছাগুলো সব বলবে। কিভাবে কি বলবে, এসব শোনার পর তাদের রিয়েকশান কি হতে পারে তা নিয়েই সে ভাবছে এখন। এতগুলো বছর যে যন্ত্রনাময় কথাগুলো নিজের ভেতর বয়ে বেড়িয়েছে সেগুলো আজকেই প্রথম কারো সাথে শেয়ার করল সে। সে বুঝতে পারছে বাবা-মা কেও এখনি বলতে হবে। আর বেশি সময় নিতে চাইছে না সে।
সকাল তাঁর চিন্তা অনুযায়ী কাজ করে, বাবা-মা দুজনকেই ডেকে বসায় তাঁর বারান্দায়। যন্ত্রের মত সে সব বলে যায়। জানিয়ে দেয় তাঁর ইচ্ছার কথাটাও। সে ইচ্ছা পূরণ করলে কি হবে না করলে কি হবে তাও খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বলে সে। সবুর সাহেব ও তাঁর স্ত্রীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সকালের মা রাবেয়া খাতুন কান্না কাটি শুরু করেন তাকে জড়িয়ে ধরে। সে ভাবে তাঁর ছেলে পাগল হয়ে গেছে; যদিও এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। তিনি এটা সাফ জানিয়ে দিলেন সকাল যা চাচ্ছে সে তা কখনোই মেনে নেবেন না। সকাল কোন তর্কে জড়ায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। সবুর সাহেব ঊঠে চলে যান; যেতে যেতেই ফোন বেজে ওঠে তাঁর। ডক্টর বন্ধু নেয়ামত আলীর ফোন। তিনি নেয়ামত আলীকে ফোন দিতেন কিছুক্ষনের মধ্যেই। ডক্টর নেয়ামত আলী বন্ধুকে সব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, সবুর সাহেব কিছুই বুঝতে চাইছেন না; আবার অভিজ্ঞ ডক্টর নেয়ামত আলীর কথা ফেলতেও পারছেন না। এক পর্যায়ে সবুর সাহেব বুঝলেন সবই কিন্তু তারপরেও সকালের ইচ্ছাপূরণের পক্ষে না তিঁনি। কিছুতেই তিঁনি মেনে নিতে পারছেন না ব্যাপারটা। কয়েক ঘন্টার মধ্যে সবুর সাহেবের বাসা পরিনত হয় শোকের রাজ্যে। এভাবেই চলতে থাকে, পার হয় বেশ কয়েকটা দিন। সবুর সাহেব এরই মধ্যে স্ত্রীকে নিয়ে ডক্টর নেয়ামত আলীর চেম্বারে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়ে এসেছেন, নেয়ামত আলী সুন্দরভাবে নিগেটিভ পজেটিভ সবকিছু বুঝিয়ে বলেছেন তাদের। যদিও তিনি কোন সিধান্ত তিনি দেননি এ ব্যাপারে, তারপরেও সকালের ইচ্ছাপূরণে কিছুটা সায় ছিল তাঁর।
রাত আড়াই টা। চারদিকে সুনসান নীরবতা। প্রতিরাতের মতই সকালের রুমের দড়জা বন্ধ। তাঁর হাতে ধারালো এক অস্ত্র। যেকোন দুর্ঘটনাই ঘটানো সম্ভব তাঁর পক্ষে। আসলে তাই ঘটল। টাইলস বসানো সাদা রঙের ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে লাল রক্তে। সকাল থামছে না। তাঁর উপর কে বা কি ভর করেছে তা সে নিজেও জানেনা। গোঙ্গানীর শব্দ। সকালের জীবনে আর নতুন কোন সকাল নেই। মেঝেতে পড়ে থাকে সকালের নিথর দেহ।