শেখ মুজিবের পরিবারের নিরাপত্তা আইন নিয়ে প্রকাশিত গেজেটটি মন দিয়ে পড়লাম দুইবার।এই আইনের অনেক ধারা নিয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার আপত্তি আছে। আছে দ্বিমত। মুজিবের পরিবার যে নিজেদের বানানো দূর্বিষহ ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন কিংবা পরবর্তী সময়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর যে আক্রমন হয়েছে নানা সময়ে সেগুলোর প্রেক্ষিতেও মুজিবের পরিবারের নিরাপত্তা হয়ত প্রয়োজন। কিন্তু সেটা কি সবাইকে দিতে হবে? সেটা পাবার ভাগীদার কি আমেরিকা প্রবাসী জয় যে কিনা বাংলাদেশের পাসপোর্ট-ই হোল্ড করে না?
কিন্তু প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে মুজিবের পরিবার কে? কাদের কাদের নিয়ে জাতির জনকের পরিবার কথাটির সুনির্দিষ্ট সীমারেখা টানা হচ্ছে কিংবা আদৌ হচ্ছে কিনা? এই পরিবার বলতে কি মুজিবের অনেক অনেক অনেক দূর সম্পর্কের আত্নীয়দের বোঝানো হবে? কিংবা তাঁর দৌহিত্র, দৌহিত্রাদের বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ ব্যাক্তিদেরও বলা হবে কিংবা বোঝানো হবে? সোজা কথা জাতির জনকের পরিবার বলতে কি বুঝায় এটা জানতে পারলাম না। কেউ জানলে দয়া করে জানাবেন। এই তথ্য জানা এই কারনেই দরকার যাতে করে কতজন মানুষ এই সুবিধার আওতায় পড়বেন সেটা বুঝতে পারা।
নিরাপত্তার কথা বলছিলাম। হ্যা নিরাপত্তার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে যদিও আমরা বাংলাদেশীরা প্রতিদিন মরি, আমাদের বাস চাপা দেয়া হয়, গাড়ি চাপা দেয়া হয়, আমরা খরায় মরি,আমরা ভুখা পেটে মরি, আমরা অপহরন আর গুমের ফলে মরি। কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে আইন-টাইন করেনা। সেগুলোর দরকার আছে বলেও আজকাল আর মনে করিনা। জন্ম যেখানে আজন্ম পাপ সেখানে এসব নিয়ে কথা বলাটাও হয়ত সময়ের অপচয়। আমরা মরব কিন্তু এলিট পরিবারের সদস্যরা সুখে থাকবে এটাই নিয়তি হয়ত।
কিন্তু এই গেজেটের কিছু পয়েন্টের দিকে তাকিয়ে উঠলে রীতিমত চমকে যেতে হয়। যেমন প্রথম ভাগের ৪ নাম্বার পয়েন্ট। যেখানে বলা রয়েছে আবাসস্থলের চতুর্পার্শ্বে বসবাসকারীদের উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হবে। এই প্রভিশনের মানে কি? বঙ্গবন্ধুর পরিবারের একজন সদস্য তাঁর মালিকানায় কিংবা রাষ্ট্রের মালিকানায় যেই আবাসে থাকবেন সেখানে বসবাসরত সবার দিকে ২৪ ঘন্টা নজরদারি করবে গোয়েন্দারা? মগের মুল্লুক নামে যে মুল্লুকের কথা শুনেছি, সেখানেও এই জাতীয় আইন হয় কিনা সন্দেহ আছে। অন্যের একজন মানুষের অধিকার হরন করবার কি অদ্ভুত আইন। এর থেকে কি এটাই ভালো না যে জাতির জনকের পরিবারের জন্য নির্জন কোনো স্থানে একটা প্রাসাদ নির্মান করা? যেই প্রাসাদের আশে পাশে ১০ মাইলের মধ্যে কেউ নেই। তাহলে অন্তত সার্বক্ষণিক নজরদারির হাত থেকে নিরীহ মানুষেরা বেঁচে যেত।
এর পর রয়েছে এই গেজেটের দ্বিতীয় ভাগ। সরকারী সুযোগ সুবিধা, গাড়ি-বাড়ী, মালি, ড্রাইভার, বাবুর্চি কি নেই জাতির জনকের পরিবারের জন্য! যদিও একজন সাধারণ বাংলাদেশী হিসেবে এগুলোর কোনো সুযোগ সুবিধা আমাদের নেই এবং জনতার ট্যাক্সের অর্থেই এসব সুযোগ সুবিধা পাবেন পরিবারের সকল সদস্য, ধরেন এটাও মেনে নিলাম। ইনফ্যাক্ট জাতির জনকের পরিবার বলতে এক্সাক্টলি কাদের কাদের বোঝানো হয়েছে এটাও ঠিক নিশ্চিত হতে পারলাম না। এই আইনের আওতায় যদি জয়,ববি, টিউলিপ, পুতুল এরা সবাই পড়েন সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায় যে এরা প্রত্যেকেই তো অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত ও যথেষ্ঠ ওয়েল অফ। প্রত্যেকেই সাবলম্বী এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকবার মত শিক্ষা তাঁরা নিয়েছেন, এমনটাই জানি। তাহলে এই সুযোগ সুবিধাগুলো তাঁদের জন্য কেন? দেশে লক্ষ লক্ষ ভিক্ষুক আছে, অনাহারী আছে, ঘর হীন আছে, বস্ত্রহীন আছে। তাঁদের অধিকার কে রক্ষা করবে? বেডরুমে এসে খুন হয়ে যায় সাধারণ পাব্লিক, তাদের নিরাপত্তার কি হবে? গাড়ির মধ্যে ধর্ষন হয়, রাস্তায় হয়, বাড়ীতে হয়, কে দেবে এসবের নিরাপত্তা? শুধু নিজেদের নিরাপত্তা আর সুখ বিবেচনা করা কতটা যৌক্তিক যেখানে দেশের মানুষের আজও মৌলিক চাহিদাগুলো পাবার নিশ্চয়তা নেই?
এই গেজেটের সবচাইতে চিন্তার অংশ হচ্ছে তৃতীয় ভাগ। এখানে আইন যিনি ড্রাফট করেছেন তিনি এত ভেইগ কিংবা অস্পষ্ট টার্ম ইউজ করেছেন যে এটিকে নানাভাবে ব্যখ্যা করা যায়। বুঝাই যায় যে এটা আনলিমিটেড সুযোগ আর সুবিধার জন্য করা হয়েছে। এই অংশে বলা হয়েছে “অন্য কোনো প্রকার নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে” বাক্যটি। এই বাক্যের সঠিক ব্যাখ্যা কি? এখন জাতির জনকের পরিবারের নিরাপত্তার লক্ষে যদি প্রত্যেক সদস্য একজন একজন করে একটা প্রাসাদ চায়, একটা জেট প্লেন চায়, একটা আলাদা এয়ারপোর্ট চায় সেগুলোও কি রাষ্ট্র দেবে?
কি আর বলব? বললেই গাল খেতে হয়। মন্দ কথা শুনতে হয়। আজকে ইংল্যান্ডেও রাণীর জন্য অসংখ্য সুযোগ আর সুবিধা রয়েছে। এগুলো নিয়ে যে কথা হয়না তা না। কিন্তু মানুষ এখানে এসব নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায় না কেননা রাষ্ট্র প্রথমে তার নাগরিকদের সকল রকমের সুযোগ আর সুবিধা এমন ভাবে নিশ্চিত করেছে, এমন ভাবে নিরাপত্তা বিধান করেছে যেখানে রাণী খানিকটা বেশী সুবিধা নিলেও এগুলো নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। বরং বেশীরভাগ মানুষ এগুলোকে মেনেই নেয়। এপ্রিশিয়েট করে। কেউ কেউ হয়ত করেনা। সেটার সংখ্যাও খুব বেশী না।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের অদ্ভুত সব টার্ম ওয়ালা আইন, বড় বেমানান লাগে। খুব চোখে লাগে। একদিকে যখন যাবতীয় সুখ আর বাকী এক বিশাল অংশের মানুষ কষ্টে থাকে তখন রাজা-গজাদের এইসব আরাম বড় কষ্ট দেয়। দুঃখ দেয়।