এই বাংলাদেশটাকেই কি আমরা চেয়েছিলাম?

নুসরাতের মৃত্যুর ঘটনায় অবৈধ প্রধানমন্ত্রী হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন। সংবাদটা শুনেই হাসি চলে এলো। অথচ সকালেই আমরা জানতে ও দেখতে পেলাম একদল লোক ধর্ষক সিরাজুদ্দৌলার মুক্তির জন্য মিছিল করছে। পুরো ব্যাপারটা হয়েছে প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় “এই সরকারের” প্রশাসনের সামনে দিয়েই এই কাজগুলো হয়েছে।

ঐ অঞ্চলের পুলিশ, র‍্যাব, চেয়ারম্যান, মেম্বার, সরকারী কর্মকর্তা, আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরা তখন ছিলো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর বিকেলে শুনি প্রধানমন্ত্রীর শোক। রাস্তার মধ্যে বি এন পি’র দুই একজন নিরীহ কর্মী প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়ালেই পুলিশের আর ছাত্রলীগের ভয়াবহ আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। কোটা সংষ্কার চাইলেই আক্রমণের মুখে পড়তে হয় উপরের ঐ দুই গ্রুপের হাতে কিংবা নিরাপদ সড়ক চাইলেই।

কিন্তু খুনীর পক্ষে রাস্তায় নামলে অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট…নেই কোনো হাতুড়ী বাহিনী…নেই কোনো হেলমেট বাহিনী… আর বিকেল বেলা প্রধানমন্ত্রীর শোক। এগুলো দেখে শুধু একটা কথাই মনে হয় যেন এক হীরক রাজার দেশে বসবাস করছি। মনে হয় এই হাসিনা সরকার বুকের উপর চেপে বসে গলাটা ঠেসে ধরেছে। শ্বাস নেয়া যায়না, একটু নিরাপদে যে ঘরে বসে থাকব সেটিরও নিশ্চয়তা নেই। এই যেন এক দেশ নয়, এটি আস্ত এক নরক।

আওয়ামীলীগ আমলে মানুষের নেই সামান্য নিরাপত্তা। মানুষ এখানে কথাই বলতে পারেনা, নেই কোনো বাক স্বাধীনতা। এইতো সেদিন বন্ধু-বান্ধবের সূত্রে জানা গেলো আমাদের বন্ধু জান্নাতুন নাঈম প্রীতির বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলার জন্য অনেকেই থানাতে গেছেন কিংবা যাবেন কিংবা আগামী কয়েকদিনের ভেতর তাঁর নামে মামলা হবে। কেন তাঁর নামে মামলা হবে? কি তাঁর অপরাধ?

আমরা জানতে পারলাম ফেসবুকে সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাহেবের দূর্নীতি নিয়ে তিনি একটা লেখা লিখেন। সে লেখাকে উপজীব্য করে তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে। কেননা যারা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করবেন, সেই মানুষগুলো মনে করেন প্রীতি আপা যা লিখেছেন, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একটি মানুষ তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করবেন, তাঁর চিন্তাপ্রসূত যুক্তি দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটকে এক ধরনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ক্রমাগতভাবে ব্লগার, লেখক, সাংবাদিক, অনলাইন একটিভিস্টদের বিরুদ্ধে এই যে মামলা দায়ের করা হচ্ছে একের পর এক এটির সারমর্ম একটাই। সেটা হচ্ছে-

“আমাদের দল, আমাদের নেতা, আমাদের দূর্নীতি, আমাদের লুটপাট, আমাদের অব্যবস্থাপনা, আমাদের অযোগ্যতা, আমাদের অসভ্যতা, আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে শুধু হ্যাঁ বলে যাও”

জয় গোস্বামীর ঐ কবিতাটির মত-

“যে আপত্তি করছে, তাকে ডাকো
যে সম্মতি দেয়নি, তাকে ডাকো
ডাকো তাকে, যে এখনো চুপ করে আছে।

আসুক এখানে, এসে সবার সমক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলুক,

হ্যাঁ বলুক, হ্যাঁ বলুক, হ্যাঁ বলুক,

আমাদের সমস্ত কথায়
আমাদের সমস্ত কথায়
আমাদের সমস্ত কথায়

হে সুভদ্র নাগরিকগণ, জেনে নিন
এ গণতান্ত্রিক দেশে আজ
আমাদের সমস্ত কথায়
হ্যাঁ বলাই আপনাদের একমাত্র কাজ”

আমরা যারা লিখি, আমরা যারা বলি, আমরা যারা চুপ করে থাকিনা, আমরা যারা নেতাদের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা কিংবা মিথ্যাচার নিয়ে প্রশ্ন তুলি সমস্ত দায় মূলত আমাদের।

আমরা তো পারতাম চুপ করে থাকতে। আমরা তো পারতাম নেতাদের নগ্ন পায়ে আছড়ে পড়তে। তাদের সমস্ত অপরাধকে অলংকার মনে করে গায়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেটা পারিনি ফলে সমস্ত দায়, যন্ত্রণা আর কষ্ট আমাদের।

একজন লেখিকার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পাল্টা বক্তব্য লিখতে দেখিনা কোনো ছাত্রলীগের নেতাকে বা যুবলীগের নেতাকে। একটি দলীয় মুরিদকে কখনো দেখিনি প্রীতি কেন ভুল লিখেছে বা সত্য লেখেনি সেটির কোনো শক্তিশালী জবাব দিতে। শুধু তাদের ফেসবুক পোস্ট, তাদের ভাষন সবখানে দেখেছি প্রীতিকে তারা কিভাবে ধর্ষন করবে, কি করে তাকে একজন পতিতা বানিয়ে দেবে সেগুলো বলবার কুৎসিত প্রতিযোগিতা। তাহলে কি আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এতই অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়লো যে কিনা একজন লেখিকার বক্তব্যের পালটা উত্তর দিতে অক্ষম? আওয়ামীলীগ কি এতই দূর্বল হয়ে গেলো যেখানে মানুষের ভাবপ্রকাশের প্রেক্ষিতে আস্ত আদালতকে কথায় কথায় ডেকে আনতে হয়?

এই যে এত আওয়ামীলীগীয় দেশপ্রেমিক, এই যে চারিদিকে মুড়ি আর মুড়কির মত বঙ্গবন্ধু সেনা, এই যে আমাদের চারপাশে শুধু নৌকা নৌকা নৌকা…এই যে আমাদের চারপাশে শুধু হাসিনা হাসিনা হাসিনা। এই যে আমাদের চারপাশে এত জয়বাংলা জয়বাংলা জয়বাংলা, এই দেখে লেখক প্রশ্ন করেছিলেন- “এত জয় বাংলা লইয়া আমি কি করিব?”

এই জয় বাংলা এখন মানুষের রক্ত খায়। এই জয়বাংলা এখন মানুষের মাংশ খায়। এই জয় বাংলা এখন চাবিয়ে চাবিয়ে খায় মানুষের বাক স্বাধীনতা, মানুষের বলবার সমস্ত অধিকার।

লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে ফেলেছে, ব্যাংক গুলোকে নিঃশেষ করে ফেলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বানিয়েছে টর্চার সেল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান হিসেবে দাঁড় করিয়েছে অযোগ্য, ব্যার্থ দলীয় বস্তুকে। স্বাস্থ্য খাতটিকে নিঃশেষ করে শেষ করে দিয়েছে সমস্ত ক্ষমতাবানেরা। এখানে টাকা ওয়ালাদের রাতের আঁধারে পার করে দেয় হয় এয়ার এম্বুলেন্সে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের ডেকে গুলি করবার পর তাদের পাঠিয়ে দেয় বিদেশে, যাবতীয় লুটেরা, যাবতীয় খুনীরা, যাবতীয় দূর্বৃত্তদের ভাড়া করা উড়োজাহাযে করে পাঠিয়ে দেয় বিলেতে।

এই সমস্ত ক্ষমাহীন অপরাধ, এই সমস্ত কালিমা, এই সমস্ত অভব্যতা নিয়ে কথা বললেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত ড্রাকোনিয়ান আইন দিয়ে আগুনের উত্তাপ দেখিয়ে দেয় ক্ষমতাসীনেরা। বলা যাবে না, ধরা যাবেনা, ছোঁয়া যাবেনা। কিচ্ছু করা যাবেনা। বেঁচে থাকতে হলে শুধু বলে যেতে হবে “হ্যাঁ” আর বেচে না থাকতে হলে রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে হবে এই দেশ ছেড়ে কিংবা হতে হবে মূক, অন্ধ ও বধির…

এমনই কি হবার কথা ছিলো এই বাংলাদেশে? এই বাংলাদেশটাকেই কি আমরা চেয়েছিলাম? খুন করে চলে যাচ্ছে, সাথে মশকারিও করছে। কোন অবদানকে অস্বীকার করা যায় বলুন?

You may also like...

Read previous post:
এটাই আমাদের বাংলাদেশ!

১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসরঘর সাজিয়ে প্রতিরাতে একজন ছাত্রীকে ধর্ষন করা হতো, এভাবে একশত ধর্ষন করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ...

Close