আজকের সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী, “বেশি কথা বললে কিন্তু বিদ্যুৎ পাবেন না। আমার কোন কিছু আসে যায় না। আর ভবিষ্যতে কেউ করেও দিবে সেই আশাও করতে পারবেন না। কাজেই সবাইকে অন্ধকারে থাকতে হবে। আরো যদি বলেন, তাহলে যেগুলো পাওয়ার প্লান্ট আছে সবগুলো বন্ধ করে দেই। তাহলে আর কোন অসুবিধা ও দূষণ হবে না। আপনারা হারিকেন বা কুইক বাতি জ্বালিয়ে চলবেন।
প্রথমত, এই বক্তব্যের মধ্যে আমি কোন হাস্যরস খুঁজে পাইনি, অন্তত রামপাল এর মতো এই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারে। বরং আমার কাছে এই বক্তব্যটি দেশবাসীর প্রতি একটি হুমকির ন্যায়।
১. “বেশি কথা বললে কিন্তু বিদ্যুৎ পাবেন না।” এই কথাটি দেশবাসীর প্রতি জনসমক্ষে একটি মারাত্মক হুমকি। আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রধানমন্ত্রী এই ধরনের হুমকি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন কিনা, আমার জানা নেই, সংবিধান ঘেঁটে কোথাও খুঁজে পাইনি।
২. “…আমার কোন কিছু আসে যায় না।” আপনার কেনো কিছু ‘আসবে যাবে না’? অবশ্যই আপনার ‘আসতে যেতে’ বাধ্য। আপনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রত্যেকটি সফলতা এবং ব্যর্থতার দায়ভার আপনার। মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র চেহারা দেখানোর জন্য কেউ প্রধানমন্ত্রীত্ব পায়না। আপনার প্রতি আশা ছিল অনেক, কিন্তু এভাবে হুমকি দিয়ে ভীতিটা আরও কয়েকশ গুন বাড়িয়ে দিলেন, যার অধিকার আপনাকে জনগণ দেয়নি।
৩. “…আর ভবিষ্যতে কেউ করেও দিবে সেই আশাও করতে পারবেন না।” এই কথাটি বলারও কোন অধিকার আপনি রাখেন না। দেশের মানুষ কার ওপর আশা করবে কি করবে না, তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আপনি প্রধানমন্ত্রী হননি, এটা আপনার কাজও না। বরং আপনার কাজ হলো, মানুষ কেনো আপনার কাছে ভালো কিছু আশা করবে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা, যা মানুষকে এভাবে হুমকির মুখে রেখে কখনোই সম্ভব হয়নি, হবেও না। ভুলে যাবেন না, আমরা বীরের জাতি, সকল হুমকি/আক্রমণের তোয়াক্কা না করে নিজের অধিকার আদায় করে নেওয়ার অধিকার এবং ক্ষমতা দুটিই আমাদের এখনো আছে।
৪. “…কাজেই সবাইকে অন্ধকারে থাকতে হবে। আরো যদি বলেন, তাহলে যেগুলো পাওয়ার প্লান্ট আছে সবগুলো বন্ধ করে দেই।” এ কেমন হুমকি দিলেন আপনি প্রধানমন্ত্রী সাহেবা? আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে এ ধরনের হুমকি দিতে পারেন না আমাদের। আপনি কেনো আপনার ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন? কেনো দেশের মানুষকে অন্ধকারে রাখার হুমকি দিচ্ছেন?
তাছাড়া আপনার এই বক্তব্য সরাসরি আমাদের বাকস্বাধীনতার ওপর হুমকি। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, দেশের মানুষ তাদের প্রত্যাশা আপনার কাছে ব্যক্ত করার অধিকার রাখে, এবং সেই প্রত্যাশা না রাখতে পারার মতো যদি কোন সঠিক ব্যাখ্যা থাকে, আপনার উচিত তা সুন্দর করে যুক্তিসম্মতভাবে উপস্থাপন করা, এভাবে হুমকি দিয়ে নয়।
জনাবা প্রধানমন্ত্রী, আমাদের বাংলাদেশের ৩৯ ধারায় কি বলা হয়েছে মনে আছেতো আপনার?
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ ধারায় বলা হয়েছে, (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।
(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার
নিশ্চয়তা দান করা হইল।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আপনার এই ধরনের হুমকি যুক্ত বক্তব্যে সংবিধানের ৩৯(ক) অমান্য করা হয়। কারন আপনি রামপাল নিয়ে কথা না বলার জন্য হুমকি দিয়েছেন। যার অধিকার বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার নেই, আপনার কাজ এই সংবিধানের প্রতিটি ধারা রক্ষা করা ও পালন নিশ্চিত করা। এই ক্ষেত্রে কি আপনাকে সংবিধান মান্য করায় ব্যর্থ বলা যেতে পারে? প্রশ্নটা আসলে আপনার কাছেই রাখলাম। নাহলে হয়তো আপনার বক্তব্যের বিরুদ্ধে বলার কারনে আমাকে আইনী বেড়াজালে ফেলার প্রয়াস করবেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ দফাতে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে [ এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে]৷”