বিবিসিকে দেয়া প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বক্তব্য মিথ্যায় ভরপুর

কয়েকদিন আগে বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাতকারে নৈশ ভোটের সরকার প্রধান শেখ হাসিনা প্রত্যেক ছত্রে ছত্রে মিথ্যাচার করেছেন।

তিনি বলেছেন, “মানুষ যদি সত্যিই ভোট দিতে না পারতো, তাহলে তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ আন্দোলনে নামত এবং আমরা ক্ষমতায় থাকতে পারতাম না।”

নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষ একদিন আন্দোলনে নামবে আর ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করবে।

হাসিনা সরকার ভিন্নমতের উপরে এমন খড়্গহস্ত যে আন্দোলনে নামার এমনকি কোন রাজনৈতিক সমালোচনা করার সাহসও বাংলাদেশের মানুষ পায়না।

২০১৫ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সমর্থক রেহমান সোবাহান পাকিস্তান শাসনামলে নিজের লেখার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “ওই সব দিনে ফিরে গেলে এটা ভাবি, কীভাবে এসব কথা সেদিন বলতাম। এসব কথা বলার সময় ডান-বাম চিন্তা করতাম না। এসব বলতে পারতাম, কারণ এগুলো ছিল মনের কথা। কিন্তু এখন কোনো লেখা লিখতে গেলে এটি প্রকাশের আগে এক সপ্তাহ লেগে যায় এবং পাঁচবার পড়ে মত দেন রওনক (তাঁর স্ত্রী)। স্বাধীন বাংলাদেশের অন্য সবার মতো আমাকে আজকাল প্রতিটি শব্দ নিয়ে ভাবতে হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসনামলে আমরা টেবিলে বসেই দুই ঘণ্টায় যেকোনো কিছু লিখতে পারতাম।”

এর অর্থ হচ্ছে, পাকিস্তান আমলেও শুধুমাত্র মত প্রকাশের জন্য এতো নিগ্রহ হয়নি যা এখন হাসিনার আমলে হচ্ছে, এবং তা থেকে আওয়ামী লীগের এলিট সমর্থকেরাও রেহাই পাচ্ছেনা।

রাজনৈতিক নিগ্রহের কিছু ঘটনা ও কয়েকটা পরিসংখ্যান উল্লেখ করলে বিষয়টা হয়তো আরো পরিষ্কার হবে।

গত প্রায় পাঁচ বছরে আশি হাজার মামলা করা হয়েছে বিএনপির বিশ লাখ নেতা ও কর্মীকে আসামী করে। পৃথিবীতে এতো ব্যাপক সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কোন নজির নেই। বিএনপির কমিটির তালিকা ধরে ধরে মামলা দেয়া হয়। প্রথমে অজ্ঞাতনামাদের নামে মামলা করে পরে বিএনপির নেতা কর্মীদের নাম সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমন গায়েবী মামলা হয়েছে যেখানে কথিত অপরাধ সংগঠিতই হয়নি। এমনকি অনেক আগে মৃত, অপরাধ সংগঠনের সময়ে বিদেশে ছিলেন, পঙ্গু, মারাত্মক অসুস্থ, জেলে বন্দি এমন অনেকের নামেই নাশকতার মামলা দেয়া হয়েছে। এমনকি বজ্রপাতের শব্দকে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ বলে দাবী করে পুলিশ বিএনপির কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এটা শুধু বিএনপির মামলার হিসাব। এর বাইরে জামায়াত ও হেফাজতের নামেও অসংখ্য মামলা আছে। সব মিলিয়ে বিরোধী নেতা কর্মিদের নামে কত মামলা আছে সেটা সম্ভবত কেউই জানেনা। সারা দেশের জেলগুলোতে সেগুলোর ধারণ ক্ষমতার চাইতে তিনগুণ বেশী বন্দী রয়েছে। তাদের বিশাল এক অংশই বিরোধীদলের সদস্য।

লাখ লাখ বিরোধী নেতা কর্মী ঘরছাড়া। তারা ঢাকায় দারোয়ান বা মুটের কাজ করে, ট্যাক্সিক্যাব, রিক্সা চালায়। অনেকে দেশান্তরি হতেও বাধ্য হয়েছে। প্রত্যাকদিন ৮৮ জন বাংলাদেশী ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। এমনকি সাবেক প্রধান বিচারপতিকেও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। তিনিও কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।

এছাড়াও আছে বিরোধী নেতা কর্মীদের গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা। এক বছরেই প্রায় একশোর মত ভিন্নমতের মানুষ গুম হয় বাংলাদেশে যারা কখনো আর ফিরে আসেনা। কয়েক হাজার বিরোধী নেতা কর্মীকে ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি নিজেই এক বছরের বেশি সময় ধরে শুধু লেখালেখির কারণে পলাতক জীবন যাপন করছি, কারণ সামরিক গোয়েন্দারা আমাকে খুঁজছে।

যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নির্মমভাবে দমন কয়া হয় বাংলাদেশে। ২০১৩ সালের ৫ই মে হেফাজতের সমাবেশে তিনদিক থেকে ঘিরে ধরে গুলি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। সেই সময়ে দুই দিনের ঘটনায় মোট ৩৯ জন নিহত হয় বলে সরকার সমর্থক সংগঠন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিলো।

২০১৭-২০১৮ সালে নির্দোষ অরাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিলো দুটো। একটা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সরকারী চাকুরিতে কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলন। এই আন্দোলন সরকার সমর্থক গুণ্ডারা পুলিশের ছত্রছায়ার ছাত্র ছাত্রী নির্বিশেষে পিটিয়ে, আহত করে, রক্তাক্ত করে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। শুধু তাই নয় আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার করে ভয় দেখিয়ে নিশ্চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছে।

এরপরে হয়েছিলো স্কুলের ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন। এই আন্দোলন সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানির নেতৃত্বে সংগঠিত গুণ্ডাবাহিনী পুলিশের ছত্রছায়ায় ছোট ছোট বাচ্চাদের নির্মমভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে রাস্তা ছাড়া করে। এর আগে এই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন মোকাবেলায় পুলিশের দশ দফা কর্ম পরিকল্পনা করা হয় । তার মধ্যে একটা দফা ছিলো “ছাত্রলীগকে পুলিশের সাথে রাখা”

এমন সব বিভতস নির্মমতা জারি রেখে শেখ হাসিনা সকল প্রতিবাদ প্রতিরোধকে টুঁটি চিপে বন্ধ করে। আর আজকে বিবিসিতে গিয়ে তিনি বলেন যে জনগণ ভোট না দিতে পারলে আন্দোলন করতো!!!!

সোভিয়েত রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী শাসন ৭০ বছর এভাবেই টিকে ছিলো। এই ৭০ বছরে সোভিয়েত রাশিয়ায় কোন আন্দোলন হয়নি বলে কি কেউ ধরে নেয় যে সেখানে সুশাসন ছিলো? শেখ হাসিনাকে বরং প্রশ্ন করা উচিত ছিলো ‘আপনি কেন গুণ্ডা আর পুলিশ লেলিয়ে এই ছোট ছোট ছেলেদের রক্তাক্ত করেছিলেন তাদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়?’ ওরা কি সরকার উতখাতের আন্দোলন করছিলো? যে সব সাংবাদিক এসব সাক্ষাতকার নেয়, তারা আগে থেকে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে রাখলে এমন সাক্ষাতকারে উপযুক্ত প্রশ্ন করে শেখ হাসিনাকে তার নিজের কথার জালেই বন্দী করে ফেলা যেত।

আমি শেখ হাসিনার একটা সাক্ষাতকার নিতে চাই। কোন বিদেশী সংবাদ মাধ্যম কি আমাকে সেই সুযোগ দেবেন?

You may also like...

Read previous post:
বিশ্বের বৃহত্তর অস্ত্রের চোরাচালান জব্দ হওয়ার দীরঘ সময় পরেও মূল হোতারা রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে

দেশের বাইরে থেকে আসা ও দেশে তৈরি অস্ত্রের মজুদ গড়ে উঠছে বৃহত্তর চট্টগ্রামে। অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্রের চালান...

Close