বাংলাদেশের ইতিহাসে, ঘৃণ্য ও কুখ্যাত আরের রাজাকারের নাম হল মতিউর রহমান নিজামী। মানুষ তাকে মইত্যা রাজাকার নামেও জানে। নিজামী ১৯৪৩ সালে ৩১ মার্চ পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করে। তার পিতার নাম লুৎফর রহমান খান। ১৯৬৩ সালে কামিল পাশ করে। পরে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে।
রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ হয় ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জামায়েত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ যোগদান করে। উল্লেখ্য, পাকিস্তান জামায়েত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির নামে পরিচিত। টানা ৩ বার ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালে জাতির জনক বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল, জামায়েত ইসলামী সহ এই দলের অনেক সদস্যকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করের এবং বিচারের আওতায় আনেন। কারন এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের ভুমিকায় থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সমর্থন দিয়েছিল এবং গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ এসকল মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল। কিন্তু চতুর এই সকল রাজাকার গা ঢাকা দিয়েছিল। দেশ ত্যাগ করেছিলো। ১৯৭৫ সালে গভীর ষড়যন্ত্রে জাতির জনক শেখ মুজিব সপরিবারে হত্যা হবার পর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মদদে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে এই শীর্ষ কুখ্যাত রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী ওরফে মইত্যা রাজাকার।
মতিউর রহমান নিজামীর ওরফে মইত্যা রাজাকার ১৯৭১ সালে যে অপরাধ গুলো করেছিলো সেগুলো হল-
অভিযোগ ১-পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে ১৯৭১ সালের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে আরো কয়েকজনের সঙ্গে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ২-১৯৭১ সালের ১০ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের একটি সভায় নিজামী উপস্থিত ছিলেন। সভায় পরিকল্পনা করে ১৪ মে পাকিস্তানি সেনারা দুইটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪৫০ জনকে হত্যা করে এবং রাজাকাররা প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে।
অভিযোগ ৩-১৯৭১ সালের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের ঘটনায় নিজামীর সম্পৃক্ততা রয়েছে কারণ তিনি ঐ ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
অভিযোগ ৪– করমজা গ্রামে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ।
অভিযোগ ৫– ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতের বাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ২১ জন নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ৬– নিজামী ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর ধুলাউড়া গ্রামে ৩০ জনকে হত্যায় নেতৃত্ব দেন ও তার সম্পৃক্ততা ছিল।
অভিযোগ ৭– ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর সোহরাব আলী নামক এক ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হত্যা করেন।
অভিযোগ ৮– ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার ঘটনায় পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন।
অভিযোগ ৯– ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর হিন্দু অধ্যুষিত বিশালিখা গ্রামে ৭০ জনকে গণহত্যা করেন।
অভিযোগ ১০– নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডুর বাড়িতে আগুন দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ ১১– ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।
অভিযোগ ১২– ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য ১২ নম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়।
অভিযোগ ১৩– ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় বক্তব্যের জন্য ১৩ নম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়।
অভিযোগ ১৪– ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য ১৪ নম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়।
অভিযোগ ১৫– ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে নিজামী ও রাজাকার সামাদ মিয়ার ষড়যন্ত্রে সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।
অভিযোগ ১৬– ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জামায়াতের তত্কালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেন এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজামীর বিরোদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত এই মইত্যা রাজাকারের বিচার কাজ শেষ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬ টি অভিযোগ পান। এই ১৬ টি অভিযোগের মধ্যে ৮ টি প্রমানিত হয়েছে। ২০১৪ সালে ২৯ অক্টোবর আইসিটি রায়ে ৪ টি অভিযোগে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। রায়ের বিরুদ্ধে নিজামী আপিল করলেও আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় বহাল রেখে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে।
সুত্রঃ
- মতিউর রহমান নিজামী উইকিপিডিয়া
- মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্র
- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
- ১৯৭২ দালাল আইন
- স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জিয়া আর জামায়েত প্রীতি