রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও বাংলাদেশ

২০১৮ সালের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি। সেই সময়ে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ৷ কিন্তু এই মানবিকতার কারণেই এখন ক্রমাগত নিজেরাই নানা ঝুঁকিতে পড়েছে এই দেশ। চাইলেই সহজে এ সংকটের সমাধান হবে না৷ সারাদেশে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়েছে সেই সাথে বেড়েছে অন্যান্য আরও নানা চ্যালেঞ্জও৷
কক্সবাজার জেলার উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে যতদূর চোখ যায় দেখা যাবে কালো রঙের পলিথিন দিয়ে বানানো হয়েছে শত শত ঝুপড়িঘর৷ বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় এই একই চিত্র৷ পাহাড়-বনাঞ্চল এখন আর কিছুই তেমন চোখে পড়ে না৷ পাহাড়গুলো কেটে এই ঝুপড়িঘরগুলো বানানো হয়েছে৷ বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে চার হাজার একর পাহাড় কেটে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি করা হয়েছে৷ এই ঝুপড়িঘরগুলো রোহিঙ্গারা নিজেরাই তৈরি করেছে৷ ফলে ওই এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলেই ধসে পড়তে পারে পাহাড়৷ আর এমন হলে তাতে করে বহু মানুষ হতাহতের আশঙ্কাও রয়েছে৷
উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী ও আশপাশের পাহাড়ের প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী করা হয়েছে৷ এছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, পুটিবুনিয়া রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটেও রোহিঙ্গা বসতি করা হয়েছে৷
সব মিলিয়ে এমনই এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এখন যে,কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় নাগরিকরাই একরকম সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে৷ দিন দিন এই পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠছে৷ এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি৷ 

আবার সেই ২০১৮ সাল থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পেছনে বাড়তি মনোযোগ দিতে হচ্ছে৷ সেজন্য সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে৷ এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ও বেড়েছে৷ আর এই ব্যয়টা খরচ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে বাজেট থেকে৷ অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা না থাকলে এই টাকা অন্য জায়গায় ব্যয় করা যেত৷ সেটা করা গেলে দেশের কিছু মানুষ আরও কিছুটা হয়ত ভালো থাকতে পারত। 

এছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ৷ বাংলাদেশে কলেরা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও৷ বন উজার পাহাড় কেটে ধ্বংস করার সাথে সাথে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকিও আছে এর সঙ্গে৷ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এরপর আরও প্রকট হতে পারে, বাড়তে পারে নিরাপত্তা ঝুঁকিও৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো কীভাবে মোকাবেলা করবে সেটা ঠিক করাই এখন একটা চ্যালেঞ্জ৷ 
এই বিশাল জনগোষ্ঠী লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে৷ ফলে স্থানীয় লোকজনের চিকিৎসাসেবা পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে৷ তার ওপর রোহিঙ্গারা যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করছে৷ ফলে পানিবাহিত রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে৷ 

এটা বুঝতে পারা নিশ্চয়ই কঠিন কিছু নয় যে, বাংলাদেশ অবশ্যই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে৷ রোহিঙ্গাদেরও স্বাস্থ্যসেবা দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে৷ কারণ দুই লাখ মানুষের জন্য যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি, সেখানে ৯ থেকে ১১ লাখ মানুষের সেবা দিতে হচ্ছে৷ এটাও জানা গেছে পোলিও টিকা ছাড়া তারা কোনো ধরনের টিকা পায়নি৷ তাই এদেশের শিশুদের জন্য রাখা হাম-রুবেলার টিকা রোহিঙ্গা শিশুদের দেয়া হয়েছে৷ কারণ হাম একবার দেখা দিলে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ তাছাড়া মিয়ানমারে কলেরা সমস্যা ছিল ৷ তাই সংকটকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মজুদ ১০ লাখ টিকার ৯ লাখই রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছে৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার৷ সেই হিসাবে ২০১৮ সালে এই লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু আয় হওয়ার কথা ১১২ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা৷ কিন্তু আশ্রিত হিসেবে রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই৷ সেই হিসাবে রোহিঙ্গাদের পেছনে সরকারের বছরে বাড়তি ব্যয় প্রায় ৪৯ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা৷ বর্তমানে কিছু সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া গেলেও এই সাহায্য কতদিন অব্যহত থাকবে সেটা বলা মুশকিল৷

You may also like...

Read previous post:
দুর্নীতির ঘেরাটোপে শেখ হাসিনা সরকার

আশির দশকে বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার লাল কার্ড প্রাপ্তিতে ক্ষুব্ধ ফুটবলপাগল দর্শক ঢাকার রাস্তায় স্লোগান দিয়েছিল—ফিফার চামড়া তুলে নেব আমরা। সে তুলনায়...

Close