হাসিনার দেশে অনাচার

সকাল বেলাতে কাজে যাবার সময় ব্লগার সকালের সাথে স্ট্রার্টফোর্ডে সেন্ট্রাল লাইনে দেখা হয়ে গেলো হঠাত করেই । হাসি খুশি শুভ্র সতেজ একটি ছেলে । সুটেড-বুটেড হয়ে কাজে যাচ্ছে । কেউ কি দেখে বলতে পারবে এই ছেলেটি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত লন্ডনের রাস্তায় হন্যে হয়ে ঘুরছে যাতে আমাদের তেল গ্যাস যাতে বিদেশীদের হাতে তুলে না দেয়া হয় শুধু মাত্র সে জন্য ? এই ছেলেটিই আবার কখনো মানবাধিকার সংস্থায় দৌড়ুচ্ছে , ছুটছে লইয়ারের কাছে শেল, শেভরন, টাল্লা এদের বিরুদ্ধে মামলার কাগজ পত্র নিয়ে । এই যাচ্ছে সাক্ষাতকারের জন্য কিংবা লন্ডনে নতুন আসা কোনো ছেলে বিপদে পড়েছে- সকাল দৌড়াচ্ছে তার জন্য , কোনো ছাত্রকে কাজে কম বেতন দেয়া হচ্ছে কিংবা রাস্তায় হুডিরা ধরে মেরেছে , যাচ্ছে তার চিকিতসার জন্য । এমন একটি ছেলেকে দেখে ভালো না লাগবার উপায় কি ? দেশ নিয়ে আর হতাশ হতে ইচ্ছে করে না । রাজনীতি নিয়ে কিংবা রাজনীতিবিদ নিয়েও আর হতাশ হতে ইচ্ছে করে না । সকাল লিভারপুল স্ট্রীটে নেমে যেতেই আমি এসবই ভাবি । আমার গন্তব্য বন্ড স্ট্রীট পর্যন্ত । সারাটা রাস্তা আমাকে এক ধরনের আনন্দ ঘিরে ধরে । খুব সাহস হয়, সকালদের মত এমনি করে লক্ষ লক্ষ ছেলেরা এই রাস্তায় আছে । অকাতরে বিলাচ্ছে সময়, শ্রম আর মেধা । সামনে যেতে আর ভয় কি ?

দুই

আজকে কাজে অনেক বই আর ম্যাগাজিন রিটার্ন করছিলাম পাব্লিশারের কাছে । অনেক কাজ জমা হয়ে আছে স্টোরে । এখানকার ম্যাগাজিন আর বই গুলোতে অনেক সুন্দর সুন্দর গিফট থাকে । বাচ্চাদের বই আর ম্যাগাজিন রিটার্ন করবার সময় সেসব গিফট গুলো রেখে দেই সব সময় । জানি, এগুলো পাব্লিশারের কাছে ফেরত গেলে সব দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেয়া হবে । আমাদের পাশের সেকশনেই কামরুল ভাই কাজ করেন । ৩৭-৩৮ বছর একজন মানুষ । একজন প্রানোচ্ছল মানুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই । আমি সব সময় ম্যাগাজিন আর বইয়ের সাথের গিফট গুলো তার দুই বছরের মেয়েটির জন্য রেখে দেই । আমি কখনো কামরুল ভাইয়ের মেয়েটিকে দেখিনি । কিন্তু প্রায়ই কল্পনা করি, ঝাঁকড়া ছুলের বেনী করা একটি উচ্ছল শিশু । যার সামনের দুইটি দাঁত নেই । কট কট করে পাকা পাকা কথা বলছে । এরকম কল্পনা করে ভাবতে ভালই লাগে । আমি আর আমার স্ত্রী আমরা দু’জন সম্ভবত এরকম করে একটি সন্তানের কথা প্রায়ই ভাবি ।

মেয়েটির জন্য গিফট গুলো দিতে গিয়ে দেখলাম কামরুল ভাই খুব মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন । জিজ্ঞেশ করতেই যেন তিনি আরো খানিকটা ম্রিয়মান হয়ে গেলেন । কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, কুমিল্লা সদরের কান্দির পাড় এলাকার তাদের একটি ফার্নিচারের দোকান আওয়ামীলীগ সমর্থিত চেয়্যারম্যান আব্দুল রউফ দখল করে নিয়েছে । তাকে পুরোদমে পেছন থেকে সাহায্য করেছে কুমিল্লার সেই আসনের লীগের এম পি এ কে এম বাহার । বলতে বলতে কামরুল ভাইয়ের নাক লাল হয়ে উঠে । ভাই একটু দাঁড়ান বলে, পেছনে গিয়ে তিনি চোখ মুছে এলেন ।

নিজেকে সে সময় কেমন জানি একটি ভারী বোঝার মত মনে হলো । বুকের ভেতর থেকে কোথা থেকে যেন এক দলা রাগ আর ক্ষোভ গলার কাছে পাকিয়ে উঠে আসে । কামরুল ভাইয়ের বাবা মারা গেছেন, কামরুল ভাই অনেক ছোট থাকতেই । অনেকগুলো ভাই আর বোনকে এই কামরুল ভাই ধীরে ধীরে মানুষ করে তুলেছেন । র‌্যাংগসে চাকরি করতেন তিনি । জীবনে দূর্নীতি করবেন না এমন নীতি নিয়ে টিকে থাকতে পারেন নি তিনি । জীবনের দৌড়ে লন্ডনে চলে আসতে হয়েছে । আমাকে তিনি বলেন নি, অথচ আমি নিশ্চিত এই সৎ লোকটি অনেক ঋণ করে এদেশে এসেছেন । পপলারের একটি মাত্র ঘরে দুই বছরের মেয়েটি আর স্ত্রীকে নিয়ে অনেক কষ্টে থেকে মাসের পর মাস দেশে মাকে টাকা পাঠান । ১৯৬৮ সালে কেনা দোকানটি আজ দখল হয়ে গেলো । অপরাধ ? আর কিছুই নয় বেঁচে থাকতে নাকি কাম্রুল ভাইয়ের বাবা বি এন পি সাপোর্ট করতেন । আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেছে তাই এই জমি তার । কামরুল ভাইয়ের মা বার বার দেশ থেকে ফোন দিচ্ছেন, কোনো উপায় অন্তর না দেখে । কামরুল ভাইয়ের কিছু করার নেই । এই চাকরি ছেড়ে চলে গেলে হয়তবা তার হারানোর পরিমাণ আরো বেড়েই যাবে । “ভাই কি করি বলেন তো !!” এই প্রশ্নটি শুনে নিজেকে খুব অমানবিক মনে হয় । অনেক ছোট মনে হয় । মনে হয় মাটিতে মিশে যাই ক্ষুদ্র হয়ে । মনে হয় একটা দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাই এখান থেকে । কামরুল ভাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন । শপিং সেন্টারের অনেক গুলো হ্যালোজেন আলোয় কামরুল ভাই আর আমার কোনো ছায়া দেখা যায় না । কিন্তু আমাদের দুইজনের ক্লান্ত ছায়া মুখ লুকিয়ে কাঁদে । আমরা দু’জনই তা বুঝতে পারি । আমরা কাউকেই কিছু বলি না ।

তিন

শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় এলো তখন এই তিনিই ক্যান্টন্মেন্টের বাড়ী থেকে তাকে উচ্ছেদ করবার জন্য সরকারকে লেলিয়ে দিলো । আবার এরশাদের আমলে জাতীয় পার্টির অজাত লোকেরা দখল করেছে মাইলের পর মাইল । এসব দেখেই লাফাংগা কুত্তার মত তাদের এম্পি আর চ্যালা চামুন্ডারা দখল করতে শুরু করলো মাঠ , ঘাট , বাজার,ঘর আর বাড়ী, স্কুল , রাস্তা , কলেজ , ইউনিভার্সিটি । যেন এই দেশটি শুধু হাসিনা্র আর তাদের পরিবারের । যেন এই দেশটি একটি প্রতিশোধের নগরী । খালি প্রতিশোধ আর প্রতিশোধ । এক দল তাদের টার্মে দখল করে এদের পুটকির ভেতরে ঢোকায় আবার অন্য দল তাদের টার্মে তাদের পুটকির ভেতর ঢোকায় । তারা নিজেদের পুটকি তে খঞ্জর চালাতে চালাতে আমাদের বুকে খঞ্জর চালায় । আমাদের মত সাধারণ মানুষের বুকে আর পিঠে ।

যদি কোনো ভদ্রলোক উপরের সতর্কতার পরেও এখানে আমার গালাগাল দেখে মুখ সিঁটকিয়ে চলে যাচ্ছেন, তারা খালি এইটুকু বলে যান , কামরুল ভাই আর তার পরিবারের দোষ কোথায় ? যদি বলেন তাহলে আপনাদের কালই কামরুল ভাইয়ের চামড়া কেটে দেখাই । যে চামড়া এই লন্ডনের ক্ষতে আর আঘাতে , যে চামড়া রোদ আর বৃষ্টিতে শুকিয়ে শুকিয়ে অমানুষের চামড়া হয়ে গ্যাছে । যে চামড়ার নীচে কেবল থই থই করে পানি । যে শরীরের রক্ত পানি হয়ে ঝরে পড়ে অবিরাম ঘাম হয়ে । ক্লেদ হয়ে। আমাকে শুধু এইটুকু বলে যান, কামরুল ভাইয়ের দোষটা কোথায় ???? তার পরিবারের দোষ কোথায় ?

ব্লগে এই সামান্য আর্তিটুকু কেই বা পড়বে বলেন ? পড়লে তাদেরকে আরো অনেক কিছু বল্বার ছিলো । জিজ্ঞেশ করবার ছিলো আরো অনেক কথা । অনেক- অনেক কথা । তাই এই ব্লগে নিজেই হাতড়ে মরি , উন্মাদের মত চিতকার করে নিজের রাগ উপশম করি । জানি লাভ নেই । তবুও…

আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটি জনসমাবেশ করি । অনেক দীর্ঘ জনসমাবেশ । যেখানে নিরবে নিথর হয়ে দীর্ঘ মানুষের বন্যা হবে । যেখানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের মত উত্তাল মানুষেরা আসবেন নিস্তব্ধ হয়ে । আমি সেই সমাবেশে বলব “ দিয়ে দেন । সব কিছু দিয়ে দেন ওদের । আপনার বাড়ী, গাড়ি, জমি, সম্পদ , দোকান, স্কুল , কলেজ ,রাস্তা, মসজিদ, মাঠ,গীর্জা, মন্দির সব । সঅঅঅব !!! চলেন এই দেশ আমরা খালেদা আর হাসিনার চ্যালা আর কুত্তাগুলোকে দিয়ে মরে যাই । আমাদের জন্য সাড়ে তিন হাত কিংবা পোড়াবার কাঠ কিংবা কফিন না হলেও চলবে”

আমি সেই সমাবশে আরো বলতে চাই । গলা ফাটিয়ে তীব্র চিতকারে বলতে চাই,

“সব হারানোর দেশে আমাদের আর হারাবার কিছু নেই”

  • download

You may also like...

Read previous post:
৩য় শীর্ষ আলবদর নেতা মীর কাশেম আলী ও তার অপরাধ সমূহ-

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, আর এক নরঘাতক রাজাকার মীর কাশেম আলী। মীর কাশেম ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার মুন্সিদাঙ্গি সুতারলি গ্রামে জন্মগ্রহন করে।...

Close