জঙ্গি বাংলাদেশে নতুন কোনো ইস্যু নয়। তালেবান, আলকায়েদা থেকে এখন আইএস জঙ্গির খোঁজে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মধ্যেই সমস্যাটির সমাধান খুঁজছে সরকার। বিরোধী প্রতিপক্ষের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততা মিডিয়ায় বেশ কয়েক বছর প্রাধান্য পেয়েছে। এ নিয়ে কিছুটা তৃপ্তি ছিল যে পশ্চিমা দেশগুলোকে অন্তত বোঝানো গেছে যে জঙ্গি মাথাচারা দিয়ে উঠছে বাংলাদেশে, তাদের মাঝে মধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি। এরপর ৪ জন ব্লগার হত্যাকা-ের বিচার দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়েছে যখন ইতালি ও জাপানের নাগরিককে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। এখন সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে দেশে কোনো জঙ্গি নেই।
দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি আছে, গ্রেপ্তার চলছে, নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিয়ে ধৃত জঙ্গিদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে তা মিডিয়ার প্রচার পেয়েছে। এখনো মিডিয়া জঙ্গি বা বিদেশি হত্যাকা-ের জন্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করার বিষয়টি প্রচার পাচ্ছে। কিন্তু তালেবান, আল কায়েদা বা আইএস জঙ্গি নেট ওয়ার্ক আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, লিবিয়া হয়ে সর্বশেষ সিরিয়ায় অবস্থান করে মধ্যপ্রাচ্যকে যেভাবে ভগ্নস্তুপে পরিণত করছে তারই ধারাবাহিকতা যাতে বাংলাদেশকে স্পর্শ করতে না পারে সেজন্যে দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক ঐক্য ও জঙ্গি প্রশ্নে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় মেধা, প্রযুক্তি ও মিডিয়াকে ব্যবহারের কোনো রকম উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এহেন পরিস্থিতিতে জঙ্গি থাকুক না থাকুক যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটাচ্ছে তারাও দোষ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গি তৎপরতার ওপর। পুলিশ জঙ্গি খুঁজে পেলেও র্যাব ক্রসফায়ারে জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের বন্দুক যুদ্ধে ঘায়েল করার পরও নারায়ণগঞ্জে ১১ হত্যা মামলার আসামি নূর হোসেন বহাল তবিয়তে ভারতে পালিয়ে যেতে যেমন সক্ষম হয়েছেন তেমনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার স্বাক্ষী সুখরঞ্জন বালী ভারতের কারাগারে পৌঁছে গেছেন। এমনকি ব্যাংককে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসী ঢাকায় কিছুদিন আত্মগোপনের পর অন্যদেশে চলে গেছে। এসব ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা দক্ষ তা যেমন প্রশ্নের মুখে পড়েছে তেমনি তারা সন্ত্রাস দমনে কতটা মেধা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পাচ্ছে সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ দক্ষতা আছে এমন দাবি করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিসিবি প্রেসিডেন্ট ঢাকায় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলকে আন্তর্জাতিক মানের ভিভিআইপি নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা খেলতে আসেনি। এ সুযোগে দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দল আসেনি। ঢাকা সফরে আসেননি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। অনেকেই আসছেন না। ভারতের মিডিয়া প্রচার হচ্ছে অনুর্ধ ১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারতে হতে পারে।
এই যখন অবস্থা তখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সরকারি দলের সাংসদ লিটনকে দিনের পর দিন খুঁজে পাচ্ছে না। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লিটনকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আত্মসমর্পণ করুন নচেৎ গ্রেফতার। কিন্তু লিটন বহাল তবিয়তে ঢাকায় রয়েছেন, জামিনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আইন প্রণেতা হিসেবে তিনি আইনের প্রতি কোনো রকমের শ্রদ্ধা দেখিয়ে আত্মসমর্পণের কোনো চাপ অনুভব করছেন না। মাতাল অবস্থায় এক কিশোরকে গুলি করে আহত করার পর লিটন বেশ কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে একটি সমঝোতা করার চেষ্টা করছে এমন খবর মিডিয়ায় আসছে।
এসব পরিস্থিতির মধ্যে আসন্ন শীত মওসুমে পর্যটন ব্যবসায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অনেক হোটেল বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে শুরু করে বাংলাদেশ থেকে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিরা ফিরে যেতে শুরু করেছেন।
এ পরিস্থিতিতে জঙ্গি তৎপরতার জন্যে বিরোধী দলকে দায়ী করেই দায় সারছেন মন্ত্রীরা। অথচ বাংলাদেশের বর্তমান আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুনিয়াজুড়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছে। এই তোলপাড়কে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে শুরু করেছে বাণিজ্য প্রতিযোগী দেশগুলো। পোশাক খাতে বায়াররা বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেন না। শীতের আগেই পোশাক রফতানিকারকরা বাটেক্সপোর আয়োজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বিদেশ থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের অনেকেই আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সিরিয়া বা ইরাকে যুদ্ধ করতে গেছে এমন খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার পেয়েছে।
এক্ষেত্রে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় ঐক্য এখনো গড়ে ওঠেনি। নির্বাচন, রাজনৈতিক সংকট নিয়ে যেমন এর আগে রাজনৈতিক সংলাপ বিফলে গেছে তেমনি দেশে নিরাপত্তা সংকট নিয়ে সংলাপের কোনো প্রয়োজন মনে করছে না রাজনৈতিক দলগুলো। অথচ জঙ্গি দমনে বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বেশ কিছু সফলতা রয়েছে।
একযোগে দেশজুড়ে বোমা হামলার ঘটনার পাশাপাশি বাংলা ভাই, শায়েখ রহমানের উত্থান এবং পরে তাদের ফাঁসির ঘটনাও ঘটেছে। সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে তার সমাবেশে গ্রেনেড হামলাসহ রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ও পল্টনে উদিচীর অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু বারবারই জঙ্গিদের নিয়ে যে গোয়েন্দাদের প্রখর নজরদারিতে ঘটনা ঘটার আগেই এধরনের সন্ত্রাসী উদ্যোগ নাকচ করে দেয়া সম্ভব হয়নি। উল্টো জঙ্গীবাদের বিষয়টিকে অস্বীকার এবং নাকচ করে দেয়ার সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একই কায়দায় দুজন বিদেশি নাগরিককে হত্যার মত ঘটনা ঘটে গেছে।
জঙ্গীবাদ দমন ও মোকাবেলায় সরকারের জিরো টলারেন্স আছে। কিন্তু রাজনৈতিক দোষারোপের মধ্যে দিয়ে এতে পার পেয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। টক শো থেকে শুরু করে মিডিয়া নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের শাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি গোয়েন্দাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি বিরোধী তৎপরতাকে আরো আধুনিক ও দক্ষ করে তোলার জন্যে উদ্যোগ নিতে হবে। ব্লগার হত্যা বা জঙ্গি তৎপরতায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করার পর দ্রুত বিচারের কথাও বলছেন তারা।
কারণ অনেক আগেই আল কায়েদা নেতা আল জাওহারির নজর বাংলাদেশে পড়ার খবর টেলিভিশনগুলোতে ভিডিও ক্লিপ সহ প্রচার হয়েছিল। মাঝে মাঝেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের সাথে যুক্ত বলে কয়েকজনকেও আটক করা হয়েছে। আইন-শৃক্সখলা রক্ষাবাহিনীর অভিযানের কারণে নতুন নতুন জঙ্গী সংগঠন গজিয়ে ওঠার কথা শোনা যাচ্ছে। একজন আইনজীবীসহ কয়েকজনকে জঙ্গী সংগঠনকে অর্থ সমর্থন দানের জন্য গ্রেফতারও করা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকারের মন্ত্রীরা একেক জন এক এক রকম বক্তব্য রাখছেন। তাতে রাজনৈতিক দোষারোপই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিভিন্ন দাতা ও সহযোগী দেশ এরই মধ্যে প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করেছে। ভ্রমণ সতর্কবার্তা জারি কিংবা বাংলাদেশে বিদেশিদের চলাফেরায় নির্দেশনা ওই ধরনের প্রতিক্রিয়ার প্রথম পর্যায়।
টোকিওতে জাপানের মন্ত্রীপরিষদ সচিব ও শীর্ষ মুখপাত্র বলেছেন, এই ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ। যুক্তরাষ্ট্র আইএস মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের সাথে একযোগে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যান্য পশ্চিমী দেশগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে অতি দ্রুত তদন্ত কাজের সমাপ্তি এবং প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে শুধু রাজনৈতিক দোষারোপের মধ্যে দিয়ে যদি এসব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভিন্ন বার্তা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জনগণকে জঙ্গি তৎপরতায় চারপাশ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গি তৎপরতা বিরোধী কার্যক্রমের একটা সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সন্ত্রাসীদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে পারলে জনগণ সরকারের ওপর আস্থা ফিরে পাবে এবং জঙ্গি বিরোধী একটা জাতীয় ঐক্যের পথচলা শুরু হতে পারে।