আমাদের দেশের প্রচলিত আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্তচিন্তা, স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ ও রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে৷ তবে তার পেছনে যুক্তি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরাসরি রাজনীতিতে নয় বরং মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করবেন৷ তারা রাজনৈতিক দলের ভুল-ত্রুটি সংশোধনে ভূমিকা রাখবেন৷ উন্নততর চিন্তায় রাজনীতিকদের সমৃদ্ধ করবেন৷ যেই ধারণা থেকেই এটা ঘটুক না কেন এখনকার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষকসুলভ মানসিকতা বিকিয়ে দালালসুলভ মানসিকতা ধারণ করেছে পুরোদস্তুর। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার এই দীর্ঘ সময়ে তাদের পক্ষের শিক্ষকরা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এখনকার দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা যা করছেন বা তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে দলীয় নিয়োগ হওয়াতে তারা থাকছে ধরা-ছোয়ার বাইরে।
এখনকার টাকা ভাগাভাগি বা নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে অভিযুক্ত উপাচার্যদের ভেতরে শিক্ষকসূলভ নীতি-নৈতিকতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত৷ তাদের আচরণ দলের কর্মী বা নিম্নশ্রেণির নেতার মতো৷ তারা উপাচার্য হওয়ার জন্যে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছেন। আবার অনেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন৷ রাজনৈতিক দলও সেই সুযোগে সবচেয়ে অযোগ্য ‘জ্বী হুজুর’ প্রবণতার শিক্ষককে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে৷ এসব উপাচার্যকে রাজনৈতিক নেতারা যা বলেন তা তো তারা করেনই, আগ বাড়িয়েও দৃষ্টিকটু পর্যায়ের অনেককিছু করেন৷
প্রাথমিক, মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিক সব পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে এমনকি এখনো হচ্ছে মূলত অর্থের বিনিময়ে৷ একদিকে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য, অদক্ষ, অনৈতিক, দুর্নীতিসম্পৃক্ত শিক্ষক-উপাচার্যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সয়লাব, অন্যদিকে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ। আজকে শিক্ষাব্যবস্থার যে করুণচিত্র দৃশ্যমান হয়েছে, আগামীতে তা আরো প্রকট হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক বছরে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিধায় অনেক শিক্ষক টানা কয়েক মাস ক্লাস নেওয়ার সুযোগ পান না৷ সিনিয়র শিক্ষকদেরও প্রতিদিন একটির বেশি ক্লাস নিতে হয় না৷ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে৷
অধিক সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ অবশ্যই একটি ভালো দৃষ্টান্ত হতে পারত যদি শিক্ষার অগ্রগতি বিবেচনায় নিয়েই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো৷ কেননা ক্লাস নেওয়ার বাইরে শিক্ষকদের গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার সুযোগ ছিল৷ তবে বাস্তবতা হলো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মেধা-যোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি৷ মূলত ‘ভোট’ বিবেচনায় এবং রাজনীতির নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ার জন্যে৷ সেই বিজয় অর্জিত হয়েছে৷ তবে তার বিনিময়ে শিক্ষার মান এবং শিক্ষকদের পরাজিত হতে হয়েছে৷ এসব শিক্ষক নামক ‘ভোট’ নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের তদবির প্রাধান্য পেয়েছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় এর বাইরে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগেও ভয়াবহ দুর্নীতি-অনৈতিক অভিযোগ দৃশ্যমান হয়েছে৷ এমনকি শিক্ষক নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার টেলিফোন সংলাপও প্রকাশিত হয়েছে৷ নারীকেন্দ্রিক অনৈতিক অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন দলীয় শিক্ষক-উপাচার্য৷
প্রশাসনে রাজনৈতিক বিচার এবং শিক্ষায়ও রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দিলে সমস্যা ছিল না, যদি দলীয় শিক্ষকদের ভেতর থেকে যোগ্যতা সম্পন্ন কাউকে বেছে নেওয়া হতো৷ তাতো করা হয়নি বরং বেছে নেওয়া হয়েছে সবচেয়ে অযোগ্য ব্যক্তিকে। আর অযোগ্য ব্যক্তিরা স্বাভাবিক ভাবেই উপাচার্যের মতো এত বড় বা গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব ধারণ করতে পারছেন না৷ ফলে হযবরল পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছেন৷ যার পরিণতিতে নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়েছে।